প্রথমে তিন মাস, তার পর চার মাস, তার পর ছমাস। আমানুল্লা বিদেশ থেকে এক এক দু দু মাসের ম্যায়াদ বাড়ান; আর শব্নমরা ফিরতে পারে না।
সহ্যের সীমা পেরিয়ে গেল।
শব্নমদের প্রাচীন ভৃত্য তোপল খান দু-তিন মাস অন্তর অন্তর একবার করে কাবুল আসে আর শব্নমের চিঠি দিয়ে যায়—ডাককে অবিশ্বাস করার তার যথেষ্ট ন্যায্য হক্ক ছিল।
সে চিঠিতে কি ছিল আমি বলতে পারব না। ফার্সীতে ফরাসীতে মেশানো চিঠি। যে শব্নম কথায় কথায় কবিতা বলতে পারত সে বিদায়ের সময়কার মত একটি কবিতাও উদ্ধৃত করে নি কিংবা করতে পারে নি। মাত্র একবার করেছিল। তাও আমি আমার চিঠিতে সে কথার উল্লেখ করেছিলুম বলে। তখন লিখেছিল :
“আজ হুরে হালে ধরা শুদ ইক্লাহ পর্জীর
হমচু ওয়ারানে কি আজ গনজে খুদ্ আবাদ্ ন্ শুদ?
এত গুণ ধরি কি হইবে বলে দূরবস্থার মাঝে।
পোড়া বাড়িটাতে লুকনো যে ধন,-লাগে তার কোনো কাজে?”
আর ছিল কান্না আর কান্না।
প্রত্যেকটি শব্দে, প্রত্যেকটি বাক্যে। এমন কি আমাকে খুশী করবার জন্য যখন জোর করে কোন আনন্দ ঘটনার খবর দিত তখনও সেটি থাকতো চোখের জলে ভেজা।
থাক। আমার এ গুপ্তধনে কী আছে তার সামান্যতম ইঙ্গিত আমি দেব না। এখন এটি আমার চোখের জলে ভেজা।
এক বছর ঘুরে যাওয়ার পর আমি একদিন রোজা করলুম। সন্ধ্যার সময় গোসল করে, সামান্য ইফতার (পারণা) করে নমাজে বসলুম। দুপুর রাত্রে ঘুমুতে গেলুম। স্বপ্নে সত্য পথ নিরুপণের এই আমাদের একমাত্র পন্থা।
স্বপ্নদেশ হল, কান্দাহার যেয়ো না। ভোর রাত্রে।
আমার মস্তকে বজ্রাঘাত। আমি ভেবেছিলাম, কোন আদেশই পাব না এবং বিবেককে সেই পন্থায় চালিয়ে দিয়ে আমি কান্দাহারের পথ নেব।
অবশ্য কুরান শরীফে এ প্রক্রিয়ার উল্লেখ নেই। কাজেই না মানলেও কোন পাপ হবে না। কোন কোন মৌলানা এ প্রক্রিয়া অপছন্দও করে থাকেন।
এমন সময় আবদুর রহমান এসে ঘরে দাঁড়াল। আমি তার দিকে তাকালুম। বললে, ‘কাল আমি কান্দাহার যাবার অনুমতি চাই।’
আবদুর রহমান সেই যে পাগমানে গোড়ার দিকে একদিন বলেছিল আওরঙ্গজেব-পরিবার কাবুল চলে গিয়েছেন তারপর সে ওই বিষয়ে একটি কথাও বলে নি।
আমি শুধালুম, “কেন?”
‘ওখানে আমার এক ভাগ্নে আছে। তোপল খান দু মাস হল আসে নি।’
এ দুটো কথাতে কি সম্পর্ক আছে ঠিক বুঝতে পারলুম না। -একটু চিন্তা করে স্থির করলুম, আবদুর রহমানকে দিয়ে চিঠি লিখে কান্দাহার আসবার অনুমতি চাইব, আর আজ রাত্রে যদি কোনো প্রত্যাদেশ না আসে তবে তার সঙ্গে বেরিয়ে পড়তেও পারি। আবদুর রহমান চলে গেল।
আমি নত মস্তকে শ্লথ গতিতে টেবিলের দিকে চললুম, চিঠিখানা তৈরি করে রাখতে। এই এক বৎসর আমি ফার্সী শিখেছি প্রাণপণ—সেই ছিল আমার বিরহে সান্ত্বনার তীর্থ-তবু চিঠি লিখতে সময় লাগে।
টেবিলের কাছে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখি, শব্নম।
২.২ পরে শবনমের কাছ থেকেই শুনেছি
পরে শব্নমের কাছ থেকেই শুনেছি, আমি নাকি জাত-ইডিয়টের মত শুধু বিড়বিড় করে কি যেন একটা প্রশ্ন বার বার শুধিয়েছিলুম। তুমি কি করে এলে? আমি তো কোন শব্দ শুনি নি। তুমি কি করে এলে? আমি তো কোন শব্দ শুনি নি। আমার বিস্ময় লাগে, এইটেই কি আমার সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল?
অপমানিত, পদদলিত, ব্যঙ্গ-কশাঘাতে জর্জরিত নিরাশ দীনহীন জনকে যদি রাজাধিরাজ ধর্মরাজ সহসা আদর করে ডেকে নিয়ে সিংহাসনের এক পাশে বসান তখন তার কি অবস্থা হয়?
আশৈশব অপমানিত, যৌবনেও আপন নীচ জন্ম সম্বন্ধে সর্বদাই সচেতন সূতপুত্র কর্ণ যেদিন মহামান্যা ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠা কুন্তীর কাছে শুনতে পেলেন তিনি হীনজন্মা নন, তখন তার কি অবস্থা হয়েছিল?
শব্নম এতটুকু বদলায় নি। সৌন্দর্যহর কাল যেন তার সম্মুখে এসে থমকে দাঁড়িয়েছিল। গাত্ৰস্পর্শ করতে পারে নি। যাবার দিন যে রকমটি দেখেছিলুম, ঠিক সেই রকম। আমার বুকের ভিতর যে ছবি আমি এতদিন হিয়ার রক্ত দিয়ে মাখিয়ে রেখেছিলাম সে যেন আজ মুক্তিস্নান সেরে আমার সমুখে দেখা দিল। তার মুখে সব সময়ই শিশির-মধুমাস, আফগানিস্থান-হিন্দুস্থান বিরাজ করত; কপাল আফগানিস্থানের শীতের বরফের মত শুভ্র আর কপোল বোলপুরের বসন্তকিংশুকের মত রাঙা। হুবুহু সেই রকমই আছে।
শুধু কোথায় যেন ও পরিবর্তন হয়েছে। চোখে? সেইখানেই তো সর্বপ্রথম পরিবর্তন আসে। না। ঠোটের কোণে? না। গালের টোল ভরে গিয়েছে? না। সর্বশুদ্ধ? তাও না।
অকস্মাৎ বুঝে গেলুম ওর ভিতর আগুন জ্বলছে। সে আগুন সর্বাঙ্গ হতে বিচ্ছুরিত হচ্ছে।
আমার কাছে এসে, দু হাত আমার কাঁধে রেখে মস্তকাঘ্রাণ করল। বনবাসমুক্ত রামচন্দ্রকে কৌশল্যা যে রকম মস্তকাঘ্রাণ করেছিলেন।
বললে, ছিঃ! তুমি রোগা হয়ে গিয়েছ।
বুঝলুম, ওকে পুড়িয়েছে বেশী। এবং সইবার শক্তিও তার অনেক অনেক বেশী আমার চেয়ে। হৃদয়ঙ্গম করলুম, ওর কথাই ঠিক। ওর ব্যাকুলতাই বেশী। এ জীবনে বিশ্বাস ওকেই করতে হবে। মরুভূমিতে মাত্র দুজনার এই কাফেলাতে সেই নিশানদার সর্দার।
বড় ক্লান্ত কণ্ঠে বললে, আমাকে একটু ঘুমুতে দেবে?
ঘুঙুরওয়ালা চরণচক্রপরা বাড়ির নূতন বউ চলাফেরা করার সময় যে রকম দক্ষিণী বীণা বাজে, ওর গলার শব্দ সেই রকম।
শুয়ে পড়ে একটি অতি ক্ষীণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে, তুমি কিন্তু কোথাও যেয়ো না।
আশ্চর্য এ আদেশ! আমি আবার যাব কোথায়? তখন বুঝলুম, সে আদেশ দেবার পূর্বেই প্রতিপালিত হয়ে গেছে সেইটেই সত্যকার আদেশ, যে বাক্য অর্থহীন সেইটেই সব অর্থ ধরে।