পর পর দুই সন তাইলে ফসল মারা গেল। গতবার হয়েছিল খরানি আর ইবার ঝড়-বাদল। অ্যাকন দুনিয়ার দিকে তাকাইলে তা কি বোঝবার বাগ আছে? কোথা বাদল, কোথা সেই অঝোর পানি, কোথা সেই ইবলিশি হাওয়া আর কোথাই বা সেই পাষাণের মতুন আসমান। অ্যাকন ধান পাকার সোমায়, সোনা-মাখানো ধান। আসমান ভরা রোদ হবে, জানভরা ঠান্ডা হি হি বাতাস হবে, তা সবই হয়েছে, সবই হবে, শুদু মাঠে একদানা ধান নাই। ছিল যুদ্ধ, তাতেই লোক মরতে শুরু করেছিল, গাঁয়ের আদ্দেকের বেশি মানুষ অ্যাকন ন্যাংটো থাকছে, দিনের বেলায় বেরুইতে পারছে না। যারা বেরুইচে, ভাগ্যিস তাদের শরম নাই–বুড়ো-বুড়ি, রোগে-শোকে মরা মানুষ তাদের ইজ্জত থাকল, না থাকল না, কে সি কথা ভাবছে? কিছুই নাই, কিছুই নাই! যুছুতেই এই! এবার যোগ হলো আকাল। দু-বছর ধরে জমানো ধান খেয়ে খেয়ে অ্যাকন আমাদের বাকি আছে পুরনো ধানের আর মাত্তর একটি মরাই। এতে আর ক-দিন চলবে?
কত্তা কতোদিন আর বাড়ির ভেতরে আসে না। কোট-কাচারি, আমলা-ফয়লা অ্যাকন আর কেউ নাই, পেয়াদা-দফাদাররাও নাই। পালকিটো পড়ে আছে, রং চটে গেয়েছে। কাঠ ভেঙে ভেঙে পড়ছে, ঘোড়া একটো আছে বটে এখনো ঘোড়ায় চেপে কত্তা কতোদিন কোথাও যায় না!
সেই কত্তা হঠাৎ একদিন আগের মতুন হৈ হৈ করে কথা বলতে বলতে বুনের নাম ধরে ডেকে বাড়িতে এসে ঢুকল। বাড়ির মাহিন্দারটোর মাথায় বেরাট একঝুরি ভত্তি ফল। সোজা উত্তর-দুয়োরি যে ঘরে গিন্নি শুয়ে আছে, সেই ঘরে ঢুকে মাহিন্দার ছোঁড়াটোকে। ঝুরি নামাইতে বললে। শীতকালের দিন, সব ফলমূল অ্যাকন পাওয়া যায় সত্যি! তাই বলে এতরকম ক্যানে? সব পচে লষ্ট হবে। আপেল নাশপাতি বেদানা কমলা আঙুর কিসমিস খেজুর ইসব তো আছেই, আরও কতরকম আছে আমরা তার নাম জানি না। গিন্নির মাথার কাছে বসে তার একটি শুকনো হাত তুলে নিয়ে কত্ত বললে, মা, অনেকদিন আসি নাই তোমার কাছে, একবার আমার কথা শোনো। গিন্নি চোখ মুজে ছিল, তেমনি মুজেই থাকল। শুনতে পেলে কিনা, ঘুমিয়ে আছে কিনা বুঝতে পারা গেল না। এই কিছুদিন আগে পয্যন্তও গিন্নির জেগে থাকা, ঘুমিয়ে থাকা আলেদা আলেদা ছিল। জেগে আছে, না ঘুমিয়ে আছে–পষ্ট বুঝতে পারা যেত। জেগে থাকত য্যাকন, টক টক করে চেয়ে থাকত, ঘুমুইলে সমানে ঘুমুইত। এই কদিন হলো সব সোমায় চোখ মুজে থাকছে যেন চেয়ে থাকবার খ্যামতা নাই, চোখের পাতা বুজে বুজে যেচে। কত্তা আরও কবার মা মা করে ডাকলে কিন্তুক গিন্নি চোখের পাতা মেলতে পারলে না। জাগা আর ঘুমুনো তার কাছে একাকার হয়ে গেয়েছে।
সারা ঘরে রুগির গন্ধ। সি গন্ধ এমনিই যি ঘরে ঢুকলেই বমি আসে। পেশাব-পায়খানা এখনো আমিই পরিষ্কার করি আর কাউকে করতে দিই না। কিন্তুক য্যাতেই করি গন্ধ হবেই। আজ ছ-মাসেরও বেশি হলো গিন্নি শুয়ে আছে ঘরের মুদুনির দিকে চেয়ে চেয়ে। কোমরে পিঠে দগদগে ঘা হয়ে গেয়েছে। এত ধুইয়ে দি, ওযুধ দি, ঘা দিন দিন বেড়েই যেচে। গিনি মাঝে মাঝে তাকায় আমার দিকে কি যি আছে সেই চাউনিতে, কেউ বলতে পারবে না। একবার একবার মনে হয় বৈকি আর কত দিন! মনে হয়, আর নিজেই শরমে মরে যাই। কত্তা আবার ডাকলে, মা, শোনো। বহু কষ্টে গিন্নি চোখ মেললে, মনে হলো এইবার বোধায় কাকে সেই কথাটো বলবে, যি কথা আমাকে অ্যানেকদিন বলেছে। সি কথাটি এই, দুনিয়ায় বেঁচে থাকার লিয়ম আছে, তার বেশি বাঁচতে নাই। আগের দুনিয়া আছে, পরের দুনিয়াও আছে। সব দুনিয়া সবার জন্যে লয়। ভাবলম, এইকথাই বোধায় বলবে কত্তাকে। কিন্তুক গিন্নির ঠোঁটদুটি টিপে আটকানো, শুদু চোখদুটি মেলে কত্তার দিকে চেয়ে আছে। কত্তা আবার বললে, শোনো, বাজারে যতো ফলমূল পাওয়া যায়, একটা একটা করে সব এনেছি। আর তো কিছু খেতে পারো না তুমি! তবু তোমার জন্যে নয়, এনেছি আমার জন্যে, আর হয়তো কোনোদিন সুযোগ পাবো না। মা, শুধু আমার মুখের দিকে চেয়ে, আমার সামনে একটু কিছু খাও। এই বলে কত্তা গিন্নির শুনো হাতটি আর একটু নিজের দিকে টানতে গেল। ত্যাকন দেখলম, হাতটো কেমন সরতে লাগল, সরতে সরতে কত্তার হাত থেকে খসে পড়ে তার কোলে এসে পড়ল, তাপর কোল থেকে আস্তে করে মেঝেতে পড়ল। গিন্নির চোখদুটি ত্যাকননা তেমনি করে চেয়ে আছে।
একটু বাদেই কত্তা বুঝলে তার মা আর নাই।
২৫. সোংসার তাসের ঘর, তুমি রাখতে চাইলেই বা কি
দুটি বছর পেরুল। এই দুটি বছর যি কেমন করে গেল সি শুদু আমিই জানি এমন কথা বলতে পারব না। দুনিয়া জাহানে যারা আজও বেঁচে আছে, না খেয়ে শুকিয়ে মরে নাই, রোগে ভুগে মরে নাই, রাস্তায় হুরে পড়ে মরে নাই–কুনো পেকারে শুদু বেঁচে আছে, তারাই তা হাড়ে হাড়ে জানে। একটি একটি করে দিন আর যেন কাটে নাই, রোজ-কেয়ামতের লেগে অপিক্ষেও এর চাইতে ভালো।
গায়ে লোক অ্যাকন অ্যানেক পাতলা। মরার ছিল যারা, অ্যানেক খুনখুনে বুড়ো, এমনিতেই দু-দিন বাদে যারা মরবে, তাপর যারা রোগে ভুগছিল, ওষুধ-পানি তো দূরের কথা, একমুঠো খুদও জোটে নাই, তারা আর দেরি করে নাই। বিছেনায় সেই যি শুয়েছে, আর ওঠে নাই। কাউকে কিছু বলে নাই, ওষুধ চায় নাই, ভাত চায় নাই, একবার কাছে বসবার লেগে বউ-ছেলে-মেয়ে কাউকে ডাকে নাই, বোধায় জাকামদানির সোমায়েও এতটুকুন শব্দ করে নাই। হিঁদু হলে, মনে হয়, ভাই বন্ধু ছেলের কাঁধে চেপে পাঁচ কোশ দূরে ভাগীরথী নদীর পাড়ে শ্মশানে যেয়ে পোড়বার আশাও করে নাই। কি জানি, মোসলমান মওতা কবরের আশা করেছিল, না করে নাই। তবে তা একরকম করে হয়ে গেয়েছিল। কবর দেবার লেগে বেশি দূরে তো যেতে হতো না! মাঠের ধারে, পুকুরের পাড়ে, নাইলে কুনো একটা খানায় গাড় খুঁড়ে মড়া রেখে এলেই হতো। এমনি করে বুড়ো-ধুরো, জনম-রুগি, ঢোক-পিয়াসি, উদুরি যারা ছিল তারা পেথমেই গেল। তাপরে মরতে লাগল সব রোগা-ভাংরোগুলিন, আজ হোক, কাল হোক যারা মরতই। এদের মরা হয়ে গেলে বাল-বাচ্চাদের মড়ক এল। দুধের বাচ্চা, দুধ ছাড়া আর কিছু খায় না, খেতে শেখে নাই–তা মায়ের বুক এমন শুকনোর শুকননা যি চোঁ চোঁ করে টেনেও এক ফোঁটা দুধ বার করতে পারত না বুকের দুধের বাছা দুনিয়ার আসে তো দয়া করে, রহমতের মতুন। বয়ে গেয়েছে তার বাঁচতে। এয়েছেলম, থাকতে দিলি না, চললম–বোধায় এই মনে করেই সব ঝটপট বিদেয় হতো। তবে এরা মরলে কুনো হ্যাঙ্গাম-ফৈজত নাই। মাঠের ধারে এই পুকুর ঐ পুকুরের পাড়ে গাড় খুঁড়ে মাটি চাপা দিয়ে এলেই হতো। হিঁদু-মোসলমান সবাই তা-ই করত।