চিকিচ্ছের কামাই নাই। গাঁয়ের অ্যালাপ্যাথি ডাক্তার পেত্যেক দিনই আসে। তার কাছ থেকে শুনে কত্তা একদিন-দুদিন বাদে বাদে শহরে যায়, বড় ডাক্তারকে জানায় আর ওষুধ-পথ্য নিয়ে বাড়ি আসে। খোঁকা আর ওষুধ খেতে চায় না, পথ্যও কিছু খেতে চায় না। পথ্যই বা কি? ডাবের পানি, সাবু, বার্লি ইসব কি কেউ দিনের পর দিন খেতে পারে! দিনদিন ছেলে শুকিয়ে যেতে লাগল, ঠিক যেন বাঁশপাতা, বিছেনার সাথে মিশে গেয়েছে। অ্যাকন আর উঠে বসতে পারে না, দাঁড়াতে পারে না। পায়খানা-পেশাব খুব কম হয়ে গেল, কিছুই খাওয়া নাই তো, হবে কোথা থেকে? বেশিরভাগ সোমায় চোখ বন্ধ করে রাখে, মনে হয় যেন চোখের পাতা খোলারও খ্যামতা নাই। সারা দিন-রাত ছেলের মাথার কাছে বসে থাকি আর আকাশ-পাতাল ভাবি।তবে কি তাকাবে না-তবে কি থাকবে না? যেদি নাই-ই থাকে, তাইলে আমি বাঁচব কি করে? য্যাতেই বাঁচতে চাই, কি করে বাঁচব? নিজের জান তো তুশ্রু, তামাম দুনিয়া দিলে যেদি খোঁকা বাঁচে, তাইলে তা-ই হোক। আমি বিরলে বসে বাছার মুখ নিরখি—
একুশ দিনের দিন আমার হঠাৎ মনে হলো কত্ত যেন কেমন হয়ে যেচে। শহরে যাবার কথা ছিল, সিদিন সে আর শহরে গেল না, কারও সাওস হলো না তার কাছে যেয়ে একটি কতা বলে। খানিকটা বেলা হলে সে নিজে যেয়ে হেমাপ্যাথি ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে এল। হেঁটো-ধুতি পরা, চাদর-গায়ে সেই বন্ধু ডাক্তারটি রুগির ঘরে এসে দাঁড়াইলে।
তুমি বলেছিলে এ কোনো রোগই নয়, দুটো পুরিয়া দিলেই জ্বর পালাবে। আমি সব ওষুধ বন্ধ করে দিচ্ছি, দাও তোমার পুরিয়া। আমি দু-দিন দেখব, জ্বর যদি না ছাড়ে, খুন করব তোমাকে।
কত্তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি ভয় পেয়ে গ্যালমাই কেমন মুখের চেহারা! হেমাপ্যাথি ডাক্তারও বোধায় ভয় পেয়ে গেল। সে বললে, এসব কি কথা বলচ–রোগব্যাধি নিয়ে এমন কথা কি বলতে আছে। যা-ই হোক, অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে, তবু ওষুধ আমি দিচ্ছি। অন্য কোনো ওষুধ বন্ধ করতে হবে না–একসাথেই সব চলুক।
সেই কথামতো সিদিন থেকে অ্যালাপ্যাথির সাথে হেমাপ্যাথিও চলতে লাগল।
এত কিছুর মদ্যে এক মাহা আশ্চর্য হচে আমাদের গিন্নি। সারা বাড়ির এই-আবস্তায় কারুরি মাথা ঠিক নাই–কেউ অস্থির, কেউ পাথর, হাঁ-চা নাই, গোটা গাঁ যেন পেমাদ গুনছে–ইয়ারই মদ্যে আমাদের গিন্নি যেমনকার তেমনি, সেই পোষ্কার মোটা ধুতিটি পরনে, কপাল পয্যন্ত ঘোমটা। খালি পা, তবু দু-পায়ে এক কণা ধুলো নাই। ঘড়ির কাঁটার মতুন নিজের কাজগুলিন করে যেচে। সিদিন এই পেথম দেখলম, কত্তাকে কাছে ডেকে তার মাথায় হাত দিয়ে আস্তে আস্তে বললে, খোদার ওপর ভরসা রাখো বাবা!
কত্তা কুনো কথা বললে না, শুদু মায়ের মুখের দিকে কেমন করে একবার তাকাইলে, তাপর মাথা হেঁট করেই সিখান থেকে চলে গেল। খোদার ওপর ভরসা যিদিক দিয়েই রাখি না ক্যানে, অ্যাকন আমি জানি, আশা নাই, আর আশা নাই। আমার বুকের ভেতরে তাকিয়ে দেখি, সিখানে কুনো আশা নাই। খোঁকা কি নিজেও সি কথা জানতে পেরেছে? সব খাওয়া ছেড়েছে সে। মাঝে-সাঝে এট্টু পানি চেয়ে খায়, মুখে চাইতে পারে না, চোখের চাউনিতে চায়। ডাবের পানি দিতে গেলে মাথা নাড়ে, শুদু পানিই খাবে। তার মুখের কথা শুনতে গেলে কান পাততে হয় মুখের কাছে। বুকের দু-পাশের পাঁজর একটি একটি করে গোনা যায়, মুখখানি এইটুকুনি, শুদু ডাগর দুটি চোখের চাউনি আগের মতুনই আছে বরং তার রোশনাই যেন আরও বেড়েছে। না, আশা আর করব না। যেদি তাকে যেতেই হয়, তাইলে আর এত কষ্ট ক্যানে তার, তাড়াতাড়িই নিয়ে যাক তাকে আল্লা–আমি আর সইতে পারছি না, পারছি না।
একদিন এই দুনিয়াতেই দেখলম যে বেহেস্তের ছবি– সি কুনোদিন ভুলব না।খোঁকার অসুখ সারা সংসারকে অচল করে দিয়েছে। বাড়িতে যি আরও ছেলেমেয়ে আছে সব ভুলে গেয়েছি আমরা। যারা এট্টু বড় হয়েছে, তারা ভয়ে কথা বলে না, রাগ করে না, বায়না করে না। কিন্তুক কি করে ভুলে গিয়েছেলম যি বাড়িতে আমার একটি ছ-মাসের মেয়ে আছে? সি মেয়ে কার কাছে থাকে, কি খায়,কখন ঘুমোয় সি যেন দেখেও দেখতে পাই না আমি। কখনো এসে জড়িয়ে ধরে। বুকে মুখ রাখে। আমার খেয়াল-ও থাকে না। সিদিন বৈকালবেলায় রুগির ঘরে ঢুকতে যেয়ে দেখি, আমার খুঁকি কখন হামাগুঁড়ি দিয়ে ঘরে ঢুকেচে। অ্যাকন থপ থপ করে একটি-দুটি পা ফেলে হাঁটতে শিখেছে, আবার তাড়াতাড়ি করতে গেলে সাথে সাথে বসে পড়ে হামাগুঁড়ি দিয়ে এগিয়ে যাওয়াও জানে, এমনি চালাক। তা ঘরে ঢুকে দেখি, খুঁকি বড় খোঁকার মাথার কাছে খানিকটা উবুড় হয়ে দাঁড়িয়ে দু-হাত দিয়ে তার মুখে-চোখে থাপড়াইছে। আর হি হি করে হাসছে। খানিকক্ষণ থাপড় মারছে, আবার চুল ধরে টানছে আর হেসেই যেচে। আমি ভাবছি, না জানি খোঁকার চোখে খুঁকির আঙুল ঢুকে যাবে না কি, না কি নোখের আঁচড় লাগবে–কিন্তুক আমি এগুইতে পারলম না। সিখানে দাঁড়িয়েই দেখতে লাগলম–খোঁকা হাসছে, খোঁকা কথা বলছে। খোঁকার ঐ হাসি কতদিন দেখি নাই, যেন আর জন্মে দেখেছেলম খোঁকা হাসছে আর বলছে, বুবু আর মেরো না, আর মেরো না, উঃ খুব লাগছে–য্যাতো সে এইরকম বলছে, খুঁকি ততোই খুশি হয়ে হাসছে আর ভাইকে থাপড়াইছে। খোঁকা আমাকে দেখে নাই, সে বলে যেছে, বুবু, দাঁড়াও, আমার অসুখ করেছে তো, ভালো হই, তোমাকে কতো জায়গায় নিয়ে যাব, তোমাকে কত কি এনে দেব, কতো খেলনা, কতো খাবার দেব