হে নয়নানন্দ! হে আমার জীবনাকাশের প্রভাত-রবি। আমার ক্রটি ও বে-আদবী মার্জনা করিতে মর্জী হয়। হৃদয়ের নদী উচ্ছ্বসিত হইয়াছে, উহা অন্য নদীতে মিশিতে অক্ষম, উহা সমুদ্র ব্যতীত আর কাহাকেও আত্মসমর্পণ করিবে না। গোলাপ প্রস্ফুটিত হইয়াছে; কিন্তু খিজিরপুরের বুলবুল ব্যতীত আর কাহাকেও সুরভি দান করিবে না। শ্রীপুরের সরোবরে যে কমল ফুটিয়াছে, তাহার খিজিরপুরের দেবতার জন্যই ফুটিয়াছে। চরণ-প্রান্তে স্থাপন পাইবার অযোগ্য হইলেও তাহার প্রেম-দেবতা তাহাকে যোগ্যতা দান করিতে কুণ্ঠিত হইবেন না। কমলের অটল বিশ্বাস যে, তাহার দেবতা পরম হৃদয়বান্ দয়ালু। এ বিশ্বাস অটুট রাখিতে পাঠান দেবতা কি অগ্রসর হইবেন না? ইলিনীকে অনেক বুঝান হইল, সে স্পষ্ট বলিল, “আমি সূর্য ব্যতীত কাহারও পানে তাকাইব না।” চকোরকে অনেক বুঝান হইল, সে ক্ষুদ্র হইলেও গবর্ের সহিত বলিল, “চন্দ্র-সুধা ব্যাতীত আমি আর কিছু পান করিব না।”, চাতককে অনেক বুঝান হইল, সে বলিল, “আমি জলদের জল ব্যতীত অন্য জল পান করিব না।” প্রেমের নিকট সকলেই পরাস্ত, প্রেম চির-বিজয়ী। অধিনীর তাহাতে দোষ কি?
হে দেবতা!
উন্মাদিনী তাহার হৃদয়ের পাত্রে প্রীতির ফুল সাজাইয়া চরণপ্রান্তে উপস্থিত। এক্ষণে তাহার পূজা গ্রহণ করিলে দুঃখিনীর জন্ম-জীবন সার্থক হইবে। যদি অনাদর কর-ফিরাইয়া দাও তাহাও ভাল, একটি হৃদয় ভস্ম হইয়া অনন্তে মিশিবে। কিন্তু তাহাতে কি? দেবতার কোনও কার্যে দোষ নাই। বৈশাখের মেঘ ইচ্ছা করিলে গোলাপের হৃদয় বজ্রানলে দগ্ধ করিতে পারে, আবার ইচ্ছা করিলে তুষারশীতল সলিল-ধারায় তাহাকে স্নিগ্ধ করিতে পারে। সকলি মেঘের ইচ্ছা।
চরণপ্রান্তের ধূলি-আকাঙ্খিণী-
শ্রীপুরের মরু-তাপ-দগ্ধ গোলাপ
স্বর্ণময়ী।
স্বর্ণ পত্র লিখিয়া তাহার একপ্রান্তে মুসলমানী কায়দামতে একটু আতর মাখাইয়া পুরু লেফাফায় বন্ধ করিল। তৎপর স্বহস্তের কারুকার্যযুক্ত এবং নানা প্রকারের পার্শি বয়েত অঙ্কিত একখানি সুন্দর রেশমী রুমালে তাহা বেশ করিয়া বাঁধিয়া শিবনাথের হস্তে সমর্পণ করিল। শিবনাথ পত্র পাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “দিদি, এ কিসের পাত্র?” বাড়ীর আরও সকলে, বিশেষতঃ মালতী পুনঃ পুনঃ জিজ্ঞাসা করিল, এ কিসের পাত্রঃ স্বর্ণ গম্ভীরভাবে বলিল, “ঈসা খাঁ আমাকে সেই রাতে দস্যু-হস্ত থেকে উদ্ধার করে প্রাতঃকালে সাদুল্লাপুরে রওয়ানা করবার সময় বলেছিলেন, ‘সাদুল্লাপুরে তোমার মঙ্গল মত পহুঁছান-সংবাদ আমাকে জানিও।’ এতদিন লোকাভাবে তা জানাতে পারি নাই। বড়ই বিলম্ব হ’য়েছে। অত বড় লোক, বিশেষতঃ আমাকে যেরূপ বিপদ হ’তে রক্ষা ক’রেছেন, তাতে কাজটা বড়ই অন্যায় হ’য়েছে।”
স্বর্গের ছোট মামী পার্বতীসুন্দরী বিরক্তি প্রকাশ করিয়া বলিলেন, “ছি! তোমার কোন বিবেচনা নাই। বারভূঁইয়ার দলপতি ঈসা খাঁ মসনদ আলীর কাছে রাজরাজড়ারা যোড়হস্তে দাঁড়িয়ে থাকেন; তাঁকে তুমি এত বিলম্বে মঙ্গল-সংবাদ দিতেছ! তিনি যে তোমাকে মঙ্গল-সংবাদ দিতে বলেছেন, তা তোমার চৌদ্দপুরুষের ভাগ্য। শিবনাথ এতদিন এখানে নাই বা ছিল, আমাদের বাড়ীতে কি অন্য লোকজন ছিল না? রাজার মেয়ে হ’য়েছ, বুদ্ধিটা একুট গম্ভীর কর। এলে তুমি বৈশাখ মাসে, আর মঙ্গল-সংবাদ দিচ্ছ জ্যৈষ্ঠের শেষে!”
স্বর্ণ একটু অপ্রতিভ হইবার ভাণ করিয়া বলিল,-“কি জানি মামী, আমার বড় ভুল হয়ে গেছলো, আমি সে জন্যে পত্রে ক্রটি স্বীকার ক’রেছি।” স্বর্ণ এই বলিয়া শিবনাথকে বিদায় করিয়া দিল এবং বলিয়া দিল যে, “নবাব বাড়ীর কেহ জিজ্ঞাসা করিলে বলিস যে, “শ্রীপুরের রাজবাড়ী হ’তে আসছি।’ তা’হলে অনায়াসেই নবাবের কাছে যেতে পারবি। পত্রের উত্তর নিয়ে আসা চাই। উত্তর আনলে বখ্শিস পাবি।” শিবনাথ উপদিষ্ট হইয়া, ঘাড়ে লাঠি ফেলিয়া কোমরে চাপরাস বাঁধিয়া একরাশি বাবরী চুল ঝাঁকাইতে ঝাঁকাইতে খিজিরপুরের দিকে রওয়ানা হইল।
০৫.রায়-নন্দিনী – পঞ্চম পরিচ্ছেদঃ খিজিরপুর প্রাসাদে
যথাসময়ে শ্রীমতী স্বর্ণময়ীর পত্র বহন করিয়া শিবনাথ কৈবর্ত খিজিরপুর রাজধানীতে উপস্থিত হইল। সূর্য তখন নীল আকাশের গায়ে নানা বর্ণের, নানা রকমের মনোহর মেঘের পট আঁকিয়া পশ্চিম-সাগরে ডুবু ডুবু প্রায়। এক রাত্রির জন্য বিদায় লইতেও সূর্যের মন যেন সরিতেছে না; তাই সবিতৃদের ডুবিতে ডুবিতেও সতৃষ্ণনয়নে পৃথিবী-সুন্দরীকে সহস্র কিরণ-বাহু প্রসারিত করিয়া আলিঙ্গন করিতেছেন। খিজিরপুরের নবাব বাটীর বহির্বাটীর তোরণ অতিক্রম করিয়াই শিবনাথ দেখিতে পাইল, অন্যূন এক মাইল লম্বা উত্তর-দক্ষিণ বিস্তারিত প্রকাণ্ড রাজবাটী। দেখিলেই মনে হয় যেন শ্যামল তৃণতলে রাজহংসের ডিম্ব-শ্রেণী শোভা পাইতেছে। অসংখ্য চূড়া, গুম্বজ ও মিনারের রৌপ্যকলস ও ছত্রে চওড়া এবং দেড় মাইল লম্বা এক স্বচ্ছ-তোয়া দীঘি। সুবিশাল স্বচ্ছ জলরাশিতে অসংখ্য প্রকারের জলজ কুসুমরাশি প্রস্ফুটিত হইয়া মৃদু মারুত-হিল্লোল-উত্থিত তরঙ্গরাজির সহিত তালে তালে দুলিতেছে। দূর দূরান্তর ব্যাপিয়া সে এক চমৎকার শোভা। সূর্যের হৈমাভা পড়িয়া পড়িয়া সরোবরের সৌন্দর্য যেন উথলিয়া পড়িতেছে। সরোবরে মধ্যস্থলে এক লৌহ-সেতু দ্বারা উভয় তীর সংযুক্ত। সেতু পার হইয়া আসিয়া সরোবরের তুল্য এক বিরাট রমণীয় পুস্পোদ্যানে প্রবেশ করিতে হয়। এই সুবিশাল উদ্যানে পৃথিবীর সকল দেশের নানা প্রকার পুস্পের বৃক্ষ, লতাগুল্ম সংগৃহীত হইয়াছিল। বাগানে সহস্র সহস্র পুস্পস্তবক ফুটিয়া সৌন্দর্যে দিগন্ত আলোকিত এবং সৌরভে গগন পবন আমোদিত করিত। তিনশত ভৃত্য বাগানের মালীর কার্যে নিযুক্ত ছিল। এই বাগানের শোভা দেখিয়া সকলেই মুগ্ধ ও লুব্ধ হইয়া পড়িত। মুসলমানের স্বাভাবিক সৌন্দর্য ও পুস্প-প্রিয়তা ঈসা খাঁতে বেশ স্ফূর্তিলাভ করিয়াছিল। নানা জাতীয় সুকণ্ঠ ও সুন্দর বিহঙ্গ এই চির বসন্ত সেবিত উদ্যানে বিরাজ করিত। এই উদ্যানের মধ্যেই ষাট গুম্বজী বিরাট মসজিদ। উহা আগাগোড়া রক্তপ্রস্তরে নির্মিত। কেবল জমি সবুজ মর্মরের। ভূতল হইতে গুম্বজের শীর্ষ এক শত ফিট উচ্চ। প্রত্যেক গুম্বজের মস্তকে সুবর্ণ-কলস শোভা পাইতেছে। মসজিদের চারি পার্শ্বে স্বেতপ্রস্তরের চারিটি মিনার। প্রত্যেকটির উচ্চতা একশত পঁচিশ ফিট। মসজিদের চত্বর ভূমি হইতে পাঁচ হাত উচ্চ। চারিদিকে প্রশস্ত সোপান-শ্রেণীতে পরিবেষ্টিত। সোপান-শ্রেণীর উপরে সুন্দর টবে ঋতু-পুস্পজাল ফুটিয়া অপূর্ব বাহার খুলিয়াছে। মধ্যে মধ্যে নানা প্রকারের উৎস নানা ভঙ্গিমায় নির্মল জলধারার উদ্গার করিতেছে। শিবনাথ যাহা দেখিতেছে, তাহা হইতেই আর সহসা আঁখি ফিরাইতে পারিতেছে না। সে পূর্বে কেদার রায়ের বাড়ীকেই পরশ রমণীয় ও সুবৃহৎ বলিয়া মনে করিত; কিন্তু এক্ষণে ঈসা খাঁর উদ্যান ও প্রাসাদ দেখিয়া কেদার রায়ের শ্রীপুরের বাটী তাঁহার নিকট শ্রীহীন বলিয়া মনে হইতে লাগিল। শিবনাথ দেখিল, মসজিদে অন্যূন তিন হাজার লোক মগরেবের নামাজ পড়িতেছে। সে সেই বিরাট সমজিদের দ্বারের সম্মুখে ভক্তিভরে সেজদা করিল।” বাগান পার হইয়া পুনরায় সিংহদ্বার। শিবনাথকে ঈসা খাঁর সামীয় পত্রবাহক দেখিয়া প্রহরী বলিল, “এখানেই দাঁড়াও, নবাব সাহেব নামাজ পড়তে গিয়েছেন, এখনই আসবেন।” এখানে আমরা আমাদের পাঠকগণকে জানাইয়া রাখি যে, ঈসা খাঁকে পূর্ব-বাঙ্গালার সকল লোকেই বারভূঞার নবাব বলিয়া আহবান করিত। বস্তুতঃপক্ষে তিনি একজন নবাবের তুল্য লোকই ছিলেন। তাঁহার বার্ষিক আয় পঞ্চান্ন লক্ষের উপর ছিল আজকার হিসাবে পাঁচ কোটিরও বেশী। ঈসা খাঁর সাত হাজার অশ্বারোহী, বিশ হাজার পদাতিক, দুইশত রণতরী এবং দেড়শত তোপ ছিল। অশ্বশালায় সাত হাজার অশ্ব এবং হস্তিশালায় পাঁচশত হস্তী সর্বদা মৌজুদ থাকিত। প্রত্যহ পাঁচশত ছাত্র তাঁহার প্রসাদ হইতে আহার পাইত। একশত পঁচানব্বই জন জমিদার তাঁহার অধীনে ছিল। তিনি দশ বৎসর কাল অরাজকতার জন্য বাঙ্গালার নবাব সরকারের রাজস্ব দিয়াছিলেন না। তাহাতে প্রায় আড়াই কোটি টাকা তাঁহার রাজকোষে সঞ্চিত হইয়াছিল। তিনি তাঁহার রাজ্যে দুই হাজার পুস্করিণী, তিন হাজার ইদারা, দুইশত পান্থশালা এবং ষাটটি মাদ্রাসা স্থাপন করিয়াছিল। বলা বাহুল্য যে, মুসলমানদের চিরন্তন প্রথানুসারে এই সমস্ত মাদ্রাসা অবৈতনকি ছিল। এতদ্ব্যতীত হিন্দুদের পঞ্চাশটি টোলের অধ্যাপকগণের প্রত্যেকে বার্ষিক একশত টাকা করিয়া সাহায্য পাইতেন। সেকালের এই একশত টাকা সাহায্য এ-কালের হাজার টাকা তুল্য। তিনি তাঁহার রাজ্যের নানা স্থানে তিনশত মাইলের উপর রাস্তা নির্মাণ করিয়াছিলেন। এতদ্ব্যতীত বহু শিল্পদ্রব্যের কারখানা প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। তাঁহারা কারখানায় প্রস্তুত তোপ, বন্দুক, তলোয়ার, ঘোড়ার জিন এবং কাচের দ্রব্য দিল্লীর বাদশাহী কারখানায় প্রস্তত ঐ সমস্ত দ্রব্য হইতে নিকৃষ্ট হইত না।