জ্যৈষ্ঠ মাসের শুল্কপক্ষ চতুর্দশী সন্ধ্যা বহিয়া গিয়াছে। আকাশে কৃষ্ণ জলদখন্ড শ্রেণী বাঁধিয়া হিমালয় পানে ছুটিয়াছে। চতুর্দশীর চন্দ্র এক একবার মেঘের ফাঁক দিয়া নববধূর ন্যায় প্রেম-দৃষ্টিতে সুধাবর্ষণ করিয়া আবার দেখিতে দেখিতে তখনি মেঘের আড়ালে লুকাইতেছে। জগৎ এক একবার জ্যোস্না-প্লাবিত হইয়া হাসিয়া উঠিতেছে, আবার তরল আঁধারে ম্লান হইয়া যাইতেছে। বাতাস এক একবার থাকিয়া থাকিয়া উঁচু গাছের উপর দিয়া পাতাগুলিকে করতালির মত বাজাইয়া বহিয়া যাইতেছে। কখনও কখনও বাগানের নানাজতীয় ফল ফুলের গাছের মধ্যে এলোমেলোভাবে বহিয়া যেন লুকোচুরি খেলিতেছে। ম্লান-কৌমুদী-মাখা পুকুরের জলে ছোট ছোট ঢেউ উঠিয়া শ্রুতি-মধুর তক্ তক্ শব্দে পাড়ে যাইয়া লাগিতেছে। স্বর্ণময়ী এই বাগানের মধ্যস্থ পুস্করিণীর পরিস্কার বাঁধা ঘাটে বসিয়া জ্যোৎস্নালোকে বকুলের সুদীর্ঘ মালা গাঁথিতেছে এবং গুন্ গুন্ করিয়া আপন মনে গান গাহিতেছে। মালা গাঁথিতে গাঁথিতে এক একবার কি যেন মনে ভাবিয়া পুকুরে মৃদু লহরী-লীলার দিকে মুখ তুলিয়া চাহিতেছে এবং বুকভাঙ্গা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিতেছে! স্বর্ণময়ীর কণ্ঠ যদিও গুন্ গুন্ করিতেছিল এবং চম্পক অঙ্গুলী যদিও বকুলফুলে সূতা পরাইতেছিল, তত্রাচ তাহার মন যেন কোন্ এক দেশের শোভন আকাশে পথভ্রান্ত বিহঙ্গের ন্যায় উড়িয়া বেড়াইতেছিল। আজকার চন্দ্রও যেন মেঘ-পটলে লুক্কায়িত, স্বর্ণময়ীর মুখমন্ডলেরও তেমনি দীপ্তি লাবণ্য অন্তর্হিত। তাহার বদনমন্ডল যেন কেমন এক প্রকার বিষাদ গম্ভীর বলিয়া বোধ হইতেছে। এই গাম্ভীর্যের মধ্যেও তাহাকে অতুলনীয় সৌন্দর্যশালিনী বলিয়া বোধ হইতেছে। বাতাসে তাহার ললাট-প্রান্তস্থ কেশ-কলাপ ঈষৎ দুলিয়া দুলিয়া গোলাপীগণ্ড চুম্বন করিতেছিল। মালতীসুন্দরী, স্বর্ণময়ীর মামাতো ভগ্নী। যৌবনের সীমায় পদার্পন করিয়াছে। সুতরাং তাহার দেহ-লতিকা যেমন পুস্পিত, মনও তেমনি সুরভিপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে। স্বর্ণময়ীকে সে আপনার হৃদয়ময় করিয়া তুলিয়াছে। স্বর্ণকে সে হৃদয়ের অন্তস্তম স্তর হইতে ভালোবাসে। স্বর্ণকে ভালোবাসিয়া সে নিজের জীবনকে মধুময় করিয়া তুলিয়াছে। মালতী সন্ধ্যা হইতে বাটীর কোনও ঘরের স্বর্ণকে খুঁজিয়া না পাইয়া অবশেষে বাগানে অনুসন্ধানের জন্য প্রবেশ করিল। বাগানে প্রবেশ করিয়া মালতী দেখিল যে, স্বর্ণ একলাটি বসিয়া গুন্ গুন্ করিয়অ গান করিতে করিতে মাল্য রচনা করিতেছে। সে অনেকণ স্বর্ণকে খুঁজিয়া পায় নাই, সুতরাং পুকুরপাড়ে স্বর্ণকে পাইয়া একবার তাহার সঙ্গে মজা করিবার লোভ মালতীর মনে অত্যন্ত বলবৎ হইয়া উঠিল। মালতী পশ্চাদ্দিক্ হইতে অতি ধীরে ধীরে পা টিপিয়া আসিয়া নীরবে দাঁড়াইল। স্বর্ণ তখন ঈসা খাঁর র্মর্তিধ্যানে প্রগাঢ় নিবিষ্ট, কাজেই অন্যমনস্কা ; মালতীর আগমন টের পাইল না। মালতী হাসিমুখে স্বর্ণময়ীর মালাগাঁথা দেখিতে লাগিল। স্বর্ণ দু’গাছি মালা গাঁথিয়া পার্শ্বে রাখিয়া দিয়াছিল। মালতী তাহা ধীরে ধীরে নিঃশব্দে তুলিয়া লইয়া আপনার গলায় পরিয়া খিল্ খিল্ করিয়া বেদম হাসিয়া উঠিল। স্বর্ণ অন্যমনস্কা ছিল, সুতরাং প্রথমে চমকিয়া উঠিল। তারপর মালতীর গলা ধরিয়া খুব হাসিতে লাগিল। সে হাসি যেন আর থামিতে জানে না। সে বেদম হাসির চোটে সমস্ত বাগান ও পুকুরের জলও যেন অট্র হাসিতে লাগিল। নিকটস্থ বকুল গাছের ডালের ঝোপে একটি কোকিল বোধ হয় নিদ্রা যাইতেছিল, শ্রীমতীদ্বয়ের হাসির চোটে আতঙ্কিত হইয়া কুহু কুহু করিয়া ডাকিতে ডাকিতে উড়িয়া যাইয়া পুস্করিণীর অপর পার্শ্বে আম্রবৃক্ষে আশ্রয় লইল। অনেকক্ষণ পরে হাসির বেগ থামিলে, স্বর্ণ মালতীকে বলিল, “কি লো! তুই এখানে মরতে এসেছিস্ কেন? আমাকে যে একবারে চমকে দিয়েছিস্? আমি তোর বর না কি লো? যে আমাকে ছাড়া একদন্ড থাকতে পারিস না!”
মালতীঃ আমি ভাই মরতে আসি নাই, তোমাকে ধরতে এসেছি। তোমাকে বর করতে কি আমার অমত? তুমি যদি বর হতে সাহস পাও, তাহ’লে আমি এখনই তোমাকে বরণ করি। কি বল? তোমার মত বর পেলে কি আর ছাড়ি?
স্বর্ণঃ বটে, বরের জন্য দেখছি তুই ক্ষেপে উঠেছিস্। বেশী অস্থির হ’স না, সবুর কর-মেওয়া ফলবে।
মালতীঃ তা ত! আপন স্বপন পরকে দেখাও। বরের জন্য কে ক্ষেপে উঠেছে তা মালা গাঁথাতেই টের পাওয়া যাচ্ছে, আমরা বুঝি কিছু বুঝি না?
স্বর্ণঃ কি বুঝিস্ লো! মালা তো তোর জন্যই গাঁথ্ছিলাম।
মালতীঃ বটে; আমার জন্য না ঈসা খাঁর জন্য?
স্বর্ণঃ (কুপিত হইয়া) তুই এমন কথা বল্লি যে, জিব টেনে ছিঁড়ে দেব।
মালতীঃ কেন, আমি কি বলেছি, রোজই ত তুমি ঈসা খাঁর গল্প কর। তাঁর সাহস, তার বীরত্ব, তাঁর ভালোবাসার কথা তুমিই ত বল।
স্বর্ণঃ বেশ্ ত আমি বলি, তাতে কি হয়েছে? তাঁর বীরত্বের কথা, তাঁর সাহস ও সৌন্দর্যের কথা এবং আমাকে যে তিনি দুই বার প্রাণ রক্ষা ক’রেছেন, তা আমি এক-শ বার বলবো। তাতে দোষ কি?
মালতীঃ তবে আমি কি দোষের কথা বলেছি?
স্বর্ণঃ তুই মালা দেওয়ার কথা বল্লি কেন ?
মালতীঃ ভারি ত অপরাধ ! না-পছন্দ হ’ল কিসে?
স্বর্ণঃ না-পছন্দ বা অযোগ্যতার কথা কে বলেছে?
মালতীঃ বাঃ! বা! তবেই ত তোমার পছন্দ ও যোগ্য হ’য়েছে দেখছি। তাই ত আমি মালা দিতে বলছি।