সম্মূখের একটি ক্ষুদ্র নির্ঝরিণী কুলুকুলু নাদে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঢেউ তুলিয়া বহিয়া যাইতেছে। জলের উপরে অরুণের স্বর্ণকান্তি পড়ায় গলিত সুবর্ণধারা বলিয়া বোধ হইতেছে। বেগমের হস্তে কোরান শরিফ। তিনি বিরাট ও বিশাল জ্ঞানমন্দির সমরকন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে পরম প্রীতিপূর্ণ নেত্রে চাহিয়া রহিয়াছেন। বেগমের দক্ষিণ পার্শ্বে সুসজ্জিত স্তূপাকার গ্রন্থশ্রেণী। বামপার্শ্বে পুষ্পোদ্যান। তাহাতে নানাজাতীয় ফুল ফুটিয়াছে। কয়েকটি গোলাপের উপর বুলবুল বসিয়া মধুর রাগালাপ করিতেছে। একস্থানে তিনটি হরিণ-শিশু এবং পাঁচটি ময়ূর পরস্পরের দিকে প্রীতিপূর্ণ আঁখিতে চাহিয়া রহিয়াছে! মধ্যে কমল সরোবরে কয়েক বর্ণের কমল ফুটিয়াছে, সেই ফুল্ল কমলদলে বিচিত্র চন্দ্রক-ভূষিত নায়নানন্দকর প্রজাপতিগুলি কেহ বসিয়া বসিয়া, কেহ উড়িয়া মধুপান করিতেছেন।
একধারে বহুসংখ্যক সুন্দরকান্তি ছাত্র ও ছাত্রী অধ্যয়নে লিপ্ত রহিয়াছে। মহারাজ্ঞীর চক্ষুর দৃষ্টিতে প্রতিভা এবং শান্তির পরম বিকাশ হইয়াছে। বিবি খানমের মূর্তিটি বিশ্বপ্রহাদিনী ঊষার ন্যায় মনোহারিণী, অথচ পবিত্র এবং গম্ভীর। মূর্তিটি এমনি সুকৌশলে অঙ্কিত যে দর্শন মাত্রই রাজ্ঞীর জ্ঞান-পিপাসা, সৌন্দর্যপ্রীতি এবং বিদ্যাচর্চা মহান ভাবে দর্শকের হৃদয় বিহ্বল হইয়া পড়ে। এই চিত্রে জ্ঞানপিপাসা এবং প্রতিভার যে প্রভাম ও প্রশান্ত মহিমা দেখা যাইতেছে, তাহার সামান্য অংশও হিন্দুরা সরস্বতী মূর্তিতে এবং গ্রীকরা “মিউজে” ফুটাইতে পারে নাই।
এই মহারাজ্ঞীর কোটী কোটী মুদ্রা ব্যয় করিয়া সমরকন্দের পৃথিবী-বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় এবং ছাত্রাবাস নির্মাণ করিয়ছিলেনে। নারী কর্তৃক পৃথিবীতে এরূপ বিরাট বিদ্যামন্দির আর কখনও স্থাপতি হয় নাই।
চিত্র দুইটা পাশাপাশি থাকায় বীরত্ব ও জ্ঞানের প্রভাব ও পার্থক্য সুস্পষ্ট বুঝিতে পারা যাইতেছে। আবার উভয়ের সম্মিলন কেমন প্রীতিপূর্ণ আনন্দজনক এবং অপার্থিব শক্তি ও সৌন্দর্যের প্রকাশকর, তাহাও অনায়াসে বুঝিতে পারা যায়। এ চিত্র প্রসিদ্ধ চিত্রকর আরসালমান খানের রচিত। আওরঙ্গজেব এ চিত্রের জন্যও লক্ষ্য টাকা দান করিয়াছিলেন। ফলতঃ, এই দুইখানি চিত্র এমনি সুন্দর স্বাভাবিক এবং শিক্ষাপ্রদ যে, দেখা মাত্রই সকলে মুগ্ধ হয়। ইউরোপের মাইকেল আঞ্জোলা বা র্যাফেলের পক্ষে ভাবপূর্ণ মহান চিত্র অঙ্কিত করা সম্ভবপর ছিল না। এই চিত্র ব্যতীত দিল্লীর অন্যান্য বহু সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীর এবং বীরপুরুষের চিত্র শোভা পাইতেছে।
বাদশাহ্ শাহ্ আরম আলবোলা টানিতে টানিতে গৃহমধ্যে সুগন্ধি তাম্রকুটের ধূসর ধূমের কুণ্ডলী ত্যাগ করিয়া তাইমুরের চিত্রের দিকে তাকাইয়া একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিলেন। তারপর একটু থামিয়া বলিলেন, “হায়! কি ভয়াবহ অধঃপতন! কি বীরত্বব্যঞ্জক প্রতিভামণ্ডিত মূর্তি! কিবা সাহস! পদভরে পৃথিবী কম্পিত! তরবারি-মুখে রক্তধারা পরিদৃশ্যমান! অশ্ব-পদাঘাতে অগ্নিস্ফূলিঙ্গ বিকীর্ণ হইতেছে! পৃথিবীর রাজন্যবৃন্দ ভয়ে কম্পিত এবং করজোড়ে নজরহস্তে দণ্ডায়মান। আর আমরা?-এই ভুবনবিখ্যাত বীরবংশের সন্তান আমরা। আমাদের তেজঃ-বীর্য, সাহস-শৌর্য কালের গর্ভে বিলীন! বিলাসব্যসনে দেহ ক্ষীণ ও দুর্বল। মনের ভিতরে কেবলই আশঙ্কা ও ভীতি! মনুষ্যত্বহীন-চরিত্রহীন-অধ্যবসায়হীন-ধন মান রাজত্ব প্রত্যহ লুপ্ত হইতেছে। কিঙ্করেরাও মাথা তুলিতেছে। হা অদৃষ্ট! হয় বিধি! তোমার মনে কি ইহাই ছিল! আহো! সিংহের বংশে শৃগাল, বনস্পতির বংশ তৃণ এবং সম্রাটের বংশে ভিখারী হইলাম। এমনি দুর্দশা যে, নিজের শরীরটা পর্যন্ত রক্ষা করিতে অক্ষম। যুদ্ধের দুন্দু নিনাদে পূর্বপুরুষেরা একিদিন নাচিয়া উঠিতেন। আর আমরা বাঈজীদিগের নূপুরের রুনুঝুনু ধ্বনিতে নাচিয়া উঠি। আমরা অগ্নিতে জন্মিয়া ছাই! দাহিকা-শক্তিহীন।
“অদৃষ্টের কি বিচিত্র গতি! যে মারাঠীরা দীর্ঘকাল পর্যন্ত চরণতলে পতিত ছিল, আজ তাহারাই আমাদের দণ্ডমুণ্ডের প্রভু হইয়া পড়িতেছে! হায়! যে দিল্লীর নামে জগৎ কম্পিত ছিল, আজ সেই দিল্লী দস্যুপদতলে দলিত, মথিত এবং লুণ্ঠিত! হা খোদা! এ লাঞ্ছনা, এ যন্ত্রণা তা আর সহ্য হয় না” এই বলিয়া শাহ্ অশ্রুপ্লুত নেত্রে আরও একটি দীর্ঘঃশ্বাস ত্যাগ করিলেন।
আফতাবঃ মুসলমানের প্রভাব ও প্রতিপত্তি ভারতবর্ষ হতে একেবারেই লুপ্ত হবে। এখনও যা’আছে তা’ও থাকবে না। হা খোদা! অবশেষে কি না বর্গীরা দিল্লীর ধনভাণ্ডারও লুণ্ঠন করল, বর্গীর পদ চিহ্নে দিল্লী অপবিত্র হ’ল। বাদশাহের সম্মানটুকুও রইল না! তাইমুর-খান্দানের এ অবমানানা একেবারেই অসহ্য!
সফদরজঙ্গঃ আপনি বলছেন, অসহ্য? কিন্তু ভারতীয় অন্যান্য রাজা নবাবদের ত এতটুকুও টনক নড়ল না! আজ দিল্লীর অসম্মান হ’ল, কালই অযোধ্যা, হায়দ্রাবাদ, সিন্ধু, বাঙ্গালা এবং কাশ্মীরের হবে। মারাঠীর অত্যাচার হ’তে কেউই রক্ষা পাবে না। কিন্তু এই সমস্ত নিমকহারামের দল যদি অন্ততঃ আপনাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যও দিল্লীর তখ্তের সম্মান রক্ষা করতে প্রস্তুত হ’ত, তা’হলে মারাঠীদিগকে দমন করা কঠিন হ’ত না।
মালেকঃ এরা একত্র হবে কি? এরা ত পরস্পর নিজেরাই যুদ্ধ-বিগ্রহে মত্ত। কে কা’কে মেরে বড় হবে সেই চেষ্টায়ই রত! ফলে সকলেই মারা যাবে। জাতীয়তার ভাব একেবারেই বিলুপ্ত হয়েছে। খোদার কি মর্জী বোঝা যায় না।