যখন নৃপেন কথা বলছিল, এই প্রথম আইভির সঙ্গে আমার বিয়োগান্ত নাটকের কয়েকটি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। আইভি, পর্দা তুলে, সে সবও দৃশ্য সত্যবানকে দেখিয়েছে নাকি! খুনের তদন্তে সেসব তো কোনও কাজেই লাগবে না। বরং যা বলেছিল সত্যবান, সাইক্রিয়াট্রিস্টদের উৎসাহ থাকতে পারে। সে মরা খাঁড়ি ধরে এগিয়ে গেলে যে কোনও অসুখী দম্পতির ম্যাল-অ্যাডজাস্টমেন্টের উৎসে পৌঁছনো যেতে পারে। সেই সব রোমহর্ষক প্রাপ্তবয়স্ক বিছানা-দৃশ্যের জন্য আমি আইভির কাছে কৃতজ্ঞ।
যখন হোটেল ছিল না, আইভি সেই গোড়ার দিকে দু-একবার আমাদের ফ্ল্যাটেও এসেছে। একবার হল কী, বাড়ি ফিরে, বিছানার পাশে দীপ্তি একটা ছোট্ট টিপ কুড়িয়ে পেল। এটা কোথা থেকে এল, এ তো আমাদের টিপ নয় জানতে চাইলে আমি খুব রাগ করে তাকে বলেছিলাম, তা আমি কী করে জানব। নন্দর-মা ঘর মোছে, তার হতে পারে।
পুরুষ মানুষের রাগ। দেখে ভড়কি খাবে না, এমন মেয়ে পৃথিবীতে কমই। কিন্তু, দীপ্তি তাদেরই একজন।
কিন্তু এ তো বেশ দামি টিপতর্জনীর ডগায় টিপ-পর্যবেক্ষণ করে তার ভ্রূ কুঁচকে আসে, শিপার। নন্দর-মা তো সিঁদুরের টিপ পরে।
আশ্চর্য তো। তোমার বীণাদি-মনোরমাদি কত লোক আসে, অন্য ফ্ল্যাটের মেয়েরা আসে, বাসনউলি আসে, চৈতির স্কুলের বন্ধুরা আসে টিপটা পা দিয়ে সরিয়ে মোজা পরতে পরতে আমি বলেছিলাম, খেতে দেবে না বাইরে খেয়ে নেব? আমাকে অফিস যেতে হবে। এটা মেয়েদের কলেজ নয় যে আজ দিদি এ ক্লাসটা নেবে না। এটা ব্যাঙ্ক।
তা, এরাও তো এক-একটা অ্যালিবাই। এই বীণাদি-মনোরমাদি এরা। মায়, নন্দর-মা কি বাসনউলি। এরা না থাকলে ওর অন্তত একটা বিশ্বাসকে দশ বছর ধরে খুন করে যাবার ইতিহাসটা সেদিনই ধরা পড়ে যেত।
ঘরে জানালার শার্সি সব বন্ধ। তোড়ে বৃষ্টি নেমেছে। সাইক্লোন শুরু হয়েছে। হাওয়ায় মোটর-গ্যারেজের টিনের চাল বাজছে ঝনঝন করে। গলি দিয়ে মাঝে মাঝে গাড়ি যাবার ছা শুনে বোঝা যায়, জল জমেছে। যাই বলি, অল সেড অ্যান্ড ডান, আমার এই একটা ব্যাপার—এই ফাইডেলিটির ব্যাপারটায়–সে খুবই আস্থা রাখত। ভেবে, আমার মনে মৃতা স্ত্রীর জন্য স্বামীর সহানুভূতি জাগে।
ফান মাঞ্চ? আঁ-আঁ, বলেন কি, আচ্ছা, আচ্ছা, ঠিক আছে, গিয়ে সব শুনব, রেখে দিচ্ছি, বলে রিসিভার নামিয়ে রেখে নৃপেন আমাকে জিজ্ঞাসা করল, ডেডবডির পাশে ফান মাঞ্চের একটা খালি প্যাকেট দেখেছিলে?
লাল চালচিত্র। তাতে গাঁথা কয়েকটি ওয়েফার্স। সে-যাবৎ অদেখা, অশাস্ত্রীয় প্রতিমার সেই গলাকাটা মুণ্ডু!সহসা আমি আবার সেই মুহূর্তে গিয়ে দাঁড়াই যখন হৃৎপিণ্ড জমে বরফ। যখন, টেকনিক্যালি, আমি মৃত। আমার মাথার মধ্যে ইলেকট্রন মেঘ। তার তড়িৎচৌম্বক-ক্ষেত্র থেকে ভরশূন্য সমুদ্রপাখির ডাক–কোয়ার্ক! কোয়ার্ক! কোয়ার্ক!
এই যে, আমার মাথার চুলের গোড়ায় ফের ঘাম জমছে।
ওগো তোমরা কে কে চা খাবে উঠে পড়। কারণ, এরপর সাড়ে আটটার আগে আর চা হবে না…
হ্যাঃ হ্যাঃ-হ্যাঃ-হ্যাঃ। আর ওই ফান মাঞ্চই কিনা তোমাকে বাঁচাল, আঁ! নৃপেন হাসতে হাসতে বলল, নাও, চটপট তৈরি হয়ে নাও। আমার সঙ্গে বেরুবে। আই শ্যাল ড্রপ ইউ ডাউন। কোর্ট অ্যাডজোন করে যত তাড়াতাড়ি পারি, আমি লালবাজারে আসছি।
গাড়িতে নৃপেন বলল, লোকটা জিনিয়াস। ওই ফান মাঞ্চের প্যাকেট দেখেই ও বুঝে গিয়েছিল, তুমি খুনি নও। কোনও প্রফেসনালের কাজও এ হতে পারে না। কারণ, কোনও স্বামী স্ত্রীকে খুন করে, বা ফর দ্যাট ম্যাটার কোনও প্রফেসনাল, ডেড বডির পাশে দাঁড়িয়ে ফান মাঞ্চ খেতে পারে না। এ নিশ্চয়ই কোনও জুভেনাইল ডেলিংকোয়েন্টের কাজ এবং তারা একজন নয়–ফার্স্ট স্পট এনকোয়ারিতে ও বুঝে গিয়েছিল।
লোকটির পুলিস মেডেল পাওয়া উচিত নৃপেন জানাল।
ল্যান্সডাউন মার্কেটের পর থেকে হাঁটুজল। গাড়ি ঘুরে রমেশ মিত্র দিয়ে চলল। পূর্ণ-য় উঠবে।
১৪. ওগো, তোমরা কে কে চা খাবে…
আমি তখন সঞ্জয়কে বললাম, গলাটা কেটে দে। কট্ট্ররর।
ঘরে একটা টেপ চলছিল ফুল ভলুমে। আমাকে দেখেই সত্যবান রেকর্ডারটা বন্ধ করলেন।
চিনতে পারছেন!
কৌশিক, তুই?
যা অবিশ্বাস্য, তার মুখোমুখি হতে হলে, আমার প্রবণতা হল, সঙ্গে সঙ্গে তাকে মেনে নেওয়া। কিন্তু এজন্যে আমাকে যে কী দাম দিতে হয়, সে শুধু আমি জানি আর জানে আমার ক্রীতদাস স্নায়ুমণ্ডল, যারা অ্যাজবেস্টস দিয়ে তৈরি। আগুন যাদের পোড়াতে পারে না।
হাতে-হাতকড়া, কৌশিককে চেয়ারে বসে থাকতে দেখে দীপ্তির কাটা গলা দেখেও যা হয়নি এই প্রথম তারা শরীর ছেড়ে পালাতে থাকে। আমার হুকুম তারা আর শোনে না। ভাঙতে ভাঙতে আমি একটি স্কুপে পরিণত হচ্ছি, আমি দেখি। প্রশ্নটা আমি করতে চেয়েছিলাম ডান হাতের তর্জনী তুলে। দেখলাম, সেটুকু ক্ষমতাও অন্তর্হিত হয়েছে। কোনও মতে চেয়ার ধরে তবু, আমি দাঁড়িয়ে।
আ-হ্যাঁ। কৌশিক।সত্যবান বললেন, চেনেন তো আপনি। পাড়ার ছেলে! প্রসেনজিৎ আর রাকেশ ভিকটিমকে ধরে রাখে। বুকের ওপর বসে কৌশিক মুখে টেবিল ক্লথ খুঁজে দেয়। তারপর সঞ্জয় গলা কাটে। যেন বাহাদুর ছেলে, কৌশিকের পিঠে হাত রাখলেন সত্যবান, মাত্র আধঘণ্টার মধ্যে দ্য চ্যাপ হ্যাজ কাম আউট উইথ দা এনটায়ার স্টোরি। উইথ এভূরি বিট অফ ডিটেলস্। কোনও বেগ দেয়নি। একটুও টর্চার করতে হয়নি। গলাটা কাটলি কেন রে কৌশিক? সত্যবান স্নেহ ভরে জানতে চাইলেন, তার আগেই তো মরে গিয়েছিল।