কিন্তু, আমি তো তোমাকে বিয়ে করব?
কুমারী-মাতা গলা টিপে ভ্রণ-হত্যা সম্পূর্ণ করে উঠে দাঁড়াল। এই প্রথম চোখে চোখ রাখল আমার। কখনও কখনও চোখ থেকে তারা সরে যায়। থাকে শুধু দুটি সাদা প্রস্তরখন্ড।
কিন্তু আমি তোমাকে বিয়ে করব না। আইভি উঠল, চলি।
এই, পূর্বাপর সস্নেহে ভ্যানিটিতে হাত রেখে ঘুরে দাঁড়াল একবার, তোমার কিছু টাকা লাগবে?
কাউন্টারে আইভি বিল পে করছে।
সো আর্লি মিস সোম?ম্যাডাম হুয়া জানতে চাইছেন। উনি আইভিকে খুব ভাল চেনেন। ওঁর ইনকাম ট্যাক্স ফাইল আপডেটেড করার ব্যাপারে আইভির অবদান আছে।
আই অ্যাম ইন আ হারি। হ্যাভ টু গো টু অফিস।
আমি মনে মনে দেখতে পেলাম যথারীতি একগাল হেসে ও কথাগুলো বলল। ভুলে গেছে, ও এসেছে সাড়ে পাঁচটায়। এখন সাতটা বাজে।
আমি কেবিনে বসে রইলাম। বুঝলাম, আমার কেউ নেই। এ সময় কেউ পাশে দাঁড়ায় না।
কেউ কান্ধা দেয় না।
১৩. অপারেশন ফান মাঞ্চ
ভোরের স্বপ্ন।
স্বপ্নটা আমি এই নিয়ে কমপক্ষে দশবার দেখলাম। ঘাটশিলায় ফুলডুংরি পাহাড়ের ওপাশে একটি স্মৃতিস্তম্ভ, যার অস্তিত্ব আমার স্বপ্ন বাস্তবে রয়েছে (অনেকটা আমাদের কলকাতার নদী তীরে গোয়ালিয়র মনুমেন্টের মতন), কিন্তু, বাস্তবে যা কোনওদিন দেখতে পাইনি। আজকের স্বপ্নে যোগ হয়েছিল একটা নতুন মাত্রা। স্বপ্নের দীপ্তি আজ আমাকে ঠেলে ঠেলে ডাকছিল : এই শুনছ। উনি আবার দেখা দিয়েছেন। অর্থাৎ, স্মৃতিস্তম্ভটি।
দুঃস্বপ্নের তুলনায় সুখস্বপ্নগুলি কত ক্ষণস্থায়ী!
শনিবার,৩০ মে স্বপ্নভঙ্গ হল নৃপেনের বাড়ির চারতলার সেই সিলি ঝুমঝুমিটার ত্রিকালজ্ঞ আওয়াজে : ঝিকি-ঝিনি, ঝিকি-ঝিনি, ঝিনিক-ঝিনি… চারতলার চিলেকোঠায় যে থাকে, তার ঘুম ভাঙাতে বা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে, একতলা থেকে সিল্কের কর্ড টেনে পুলি-সংলগ্ন এই ঝুমঝুমিটা বাজানো হয়। আমি সহ্য করতে পারি না এর ঠাট্টার সুর। মনে হয়, পৃথিবীর সমস্ত গম্ভীর ঘটনাকে ব্যঙ্গ করার জন্যেই এমন চোখ-মারা ফিচেলভাবে এটা বাজে। এর ফানি . আওয়াজ আমি সহ্য করতে পারি না। কতবার আমি নৃপেনকে বলেছি, এটা হাটাও। এ শুধু। টুনটুনির সেই কেয়া মজা, কেয়া মজা/রাজা খাবে ব্যাঙ ভাজার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হতে পারে। নৃপেন কর্ণপাত করেনি। তার মতে এটা একটা মিড-ভিক্টোরিয়ান পিরিয়ড পিস, এমনকি এর দড়িটিও নাকি ওরিজিনাল। (হ্যাঁ, আর তুমি ছিলে রানীর সেই খাসবেয়ারা ভারতবর্ষীয় আবদুল, রাত দুপুরে বুড়ি মাগির দরজায় দাঁড়িয়ে দড়ি খেচতে আর কি! আমি তাকে উত্তরে বলেছি, মনে-মনে।)
দরজা খুলতেই নিচে থেকে চৈতির ব্যাকুল কণ্ঠস্বর কানে এল, বাবা! বাবা! শিগগির নিচে এস। খুনিরা ধরা পড়েছে।
কদিন ধরে আবহাওয়া সংবাদে ৯০ কিলোমিটার বেগে আসন্ন সাইক্লোনের কথা বলা হচ্ছিল। ছাদে বেরিয়ে দেখি, সারা আকাশ জুড়ে শোল মাছের গায়ের মত পাঁশুটে মেঘ। বৃষ্টি এখনও দুর্বল, কিন্তু হাওয়া জোরালো। দক্ষিণ-সমুদ্র থেকে উড়ে আসছে মেঘের পরে মেঘ। তারা, জলভারে, হুস হুস করে খুব নিচু দিয়ে উড়ে যাচ্ছে।
একদিন নৃপেন সমস্ত কাগজ নিচ্ছিল। কেউ পারেনি, শুধু আজকাল-ইখটি এক্সকুসিভ করেছে। তবে, খবরটি ছোট।
খুনি চারজন। চারজনই নাবালক। জানা গেছে, তারা সকলেই শিক্ষিত, সচ্ছল পরিবারের ছেলে। তারা সবাই এ বছর হায়ার সেকেন্ডারি দিয়েছে। স্কুলে কৃতী ছাত্র হিসেবে তাদের নাম আছে। তাদের ধরা হয়েছে বদ্রীনাথের পথে। বাড়ি থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর, কেদারবদ্রী যাবার পাথেয় সংগ্রহের জন্য এরা খুন করে বলে জানা গেছে। বদ্রীনাথ থেকে ২৩ কিলোমিটার আগে, গোবিন্দঘাটে নেমে পড়ে, এরা গিয়েছিল সেখান থেকে ১৭ কিলোমিটার দূর ও ১৫০০০ ফুট উঁচু হেমকুণ্ড সাহেব গুরুদোয়ারায়। তুষার হ্রদ হেমকুণ্ড থেকে দুর্লভ ব্ৰহ্মকমল তুলে আনাই ছিল এদের সঙ্কল্প। যাত্রী সেজে পুলিস গোবিন্দঘাটে অপেক্ষা করছিল। আজ কালকা মেলে এদের কলকাতায় আনা হচ্ছে।
রিপোর্টে খুনিদের নাম, ছবি এ-সব কিছুই নেই। পুলিস দেয়নি। এক্সক্লসিভ বলে, এইটুকু খবর বেশ গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে আজকাল। চার কলমের অ্যাঙ্কার স্টোরি করেছে। হেডিং: দীপ্তি বসুরায়ের খুনিরা ধরা পড়ল মহাপ্রস্থানের পথে।
এতদিন অনেকেই খোঁজখবর নেয়নি। সকাল থেকে ফোনের পর ফোন। অফিস ইউনিয়নের সেক্রেটারি হিল্লোল রায় বললেন, আপনি আজই জয়েন করতে পারেন। হিরোজ ওয়েলকাম অ্যাওয়েটস ইউ।
সব শেষে সত্যবান মণ্ডলের ফোন এল। তখন বেলা ১০টা। বললেন, সকাল থেকে চেষ্টা করছি। লালবাজারে চলে আসুন। কালপ্রিটরা এসে গেছে।
ফোনে সত্যবানের সঙ্গে প্রথমে আমার, তারপর নৃপেনের অনেকক্ষণ কথা হল। আমি আগাগোড়া হুঁ-হাঁ করে গেলাম। কারণ, আমার সঙ্গে সত্যবান শুধু আইভির কথা বলছিলেন। সেদিনের পর আইভির সঙ্গে আর দেখা হয়নি। দেখলাম, আমার সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারে জল গড়িয়েছিল বহুদুর।
সেদিন ওয়ান-টান থেকে বেরনো মাত্র আইভি সোমকে ধরা হয়। পুলিস আগাগোড়া শ্যাডো করেছিল। অ্যান্ড, শি কনফেসড এভরিথিং। আপনার ছবি এবং মিস সোমকে নিয়ে আমি হোটেল রিলাক্স-এ যাই।সো, ফ্রম দা ভেরি থার্ড ডে অফ দা ইনসিডেন্ট অফ মার্ডার, ইউ হ্যাভ বিন এনজয়িং অ্যান ইমপ্রেগনেবল অ্যালিবাই, ইউ সি! আপনি খুন করেননি, এটা আমি অবশ্য তার আগে থেকেই জানতাম।