এসব কী উন্মাদের মতো বলছেন আপনি? এতদিন পরে!
দাঁড়ান। বাধা দিলেন সত্যবান, লেট মি ফিনিশ। আপনি স্ত্রীকে না জানিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে এক লাখ টাকা তুলে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছিলেন।
হ্যাঁ। পথে কোনও বিপদ-আপদ…
এক লাখ টাকা! না। মানতে পারলাম না। আমি ধরে নিতে পারি এবং নিয়েছি যে, এটা ছিল আপনার একটা হিসেব। ঘোড়া বিশ আর খুন পঞ্চাশ। যদি রাজি হয় কোনও ঘোড়াঅলা। আপনারা—আমি আপনাদের মোডাস অপারেন্ডি বা থট-প্রসেস নিয়েই বলছি—মশাই ভারি চ্যারিটেবল। এমন ছেলেমানুষের মতো ব্লু ছড়াতে ছড়াতে এগিয়ে যান, প্রিয় অভিভাবকের মতো হাসতে হাসতে সত্যবান জানতে চাইলেন, আচ্ছা, আচ্ছা। মানছি, এগুলো সব ডাইডাক্টিভ কু। কিন্তু মার্কেটে ক্ষেমচাদ ভাটিয়ার দোকান থেকে আপনি আমেরিকান ছুরিটা তো কিনেছিলেন? এটা তো কনফেস্ করেছেন?
কিন্তু, দেখুন, ওটা তো হঠাৎ একদিন রাগের মাথায় কিনে ফেলেছিলাম। ওর পাঞ্জার জোর কত বেশি টের পেতে পেতে শুকনো টোক গিলে আমি বলি, কিন্তু তারপর দীপ্তি যেদিন সকালে একটা কিচেন নাইফ আনতে বলল, সেদিন সন্ধেবেলা আমিই ওর হাতে সেটা তুলে দিই। দিয়ে বলি, সস্তায় পেয়ে গেলাম। এতে তোমার পাউরুটি আর আমার গলা দুটোই স্লাইস করতে পারবে। সবই তো বলেছি আপনাকে।
হ্যাঁ। কিন্তু, আমি যেটা আপনাকে বলিনি, সেটা হল ওই ছুরিটা দিয়েই আপনার স্ত্রীর গলা কাটা হয়।
আঁ!
হ্যাঁ।
কিক-কিন্তু আমি তো খুন করিনি। মামুর কাছে প্রতিবাদের সময় চৈতির তীক্ষ্ণ গলায় আমি চিৎকার করে উঠলাম।
খাপে ছুরি ঢুকিয়ে নেওয়া রণত্যাগীর আত্মসমর্পিত গলায় আমি শান্তভাবে বললাম, কিন্তু, আমি তো খুন করিনি।
অনেস্টলি, আমি এখনও তাই মনে করি।
এখনও?
এখনও। আর তাই আপনি বাইরে।
কিন্তু, কে খুনি তা কি আপনি গেস করতে পারছেন না। এখনও? এতদিনেও!
এটা ট্রেড সিক্রেট। সত্যবান বললেন, এ বিষয়ে কিছু জানতে চাইবেন না। প্লিজ।
কিন্তু, আমি যদি পালিয়ে যাই?
পালাবেন না। পালাবেন না। আপনার মতো লোকরা পালায় না। সত্যবান প্রথম ড্রয়ার খুললেন : রিভলভার। দ্বিতীয়, তৃতীয়, একেবারে শেষ ড্রয়ারে খুঁজে পেলেন ডায়েরিটা, এই যে আপনার ডায়েরিটা দেখছিলাম। উঃ, মশাই, আগাগোড়া বন্দীর একি ভয়াবহ কারাবন্দনা! এক জায়গায়, এই যে, পেজ মার্ক ধরে ডায়েরিটা খুলে উনি পড়তে শুরু করলেন, দীপ্তি, তুমি যেটাকে ভাবছ খাঁচা, সেটা খাঁচা সত্যিই, কিন্তু, পাকাটির। দীপ্তি : পাকাটির তো ভেঙে বেরিয়ে যাওনা কেন? আমি : কারণ, ভেঙে বেরুলে কী, খাঁচার বাইরে কী, আমি তা জানি না। পদচিহ্নহীন সে অজানার চেয়ে, এই জানা বন্দিদশা, এ আমারই পছন্দ। সপ্তাহে বার দুই এই চেনা দানাপানি বলে আমি পাকা পোনার পেটের মতো নরম দীপ্তির… সরি। অবভিয়াসলি, এ-সব পিলো-টক। স্ত্রীকে আপনি কিন্তু, খুব ভালবাসতেন মশাই, যাই বলুন।
ওগো তোমরা কে কে চা খাবে উঠে পড়। কারণ, এরপর সাড়ে আটটার আগে আর চা হবে না…
অ্যান্ড শি ওয়াজ আ রিমার্কেবল উওমান ইনডিড। কলেজের কলিগ এবং ছাত্রীরা শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়স্বজন, আপনার বন্ধু এবং বন্ধুপত্নীরা যেখানে গেছি সবাই, সবাই ওঁর গুণমুগ্ধ। তবু কেন যে আপনারা এ-ভাবে ঘর পোড়ালেন, সাইকিয়াট্রিস্টরা হয়ত বলতে পারবেন। এ আমাদের পুলিসের কর্ম নয়।
হ্যাঁ। কিন্তু খাঁচা পাকাটি, এসবের সঙ্গে আমার না-পালানোর সম্পর্ক কী, কই কিছু বললেন না তো?
বললাম তো। ওই যে জানা-অজানা? গোটা লালবাজারটাই তো আপনার একটা পাকাটির খাঁচা, উনি হাত ঘুরিয়ে দেখান, কই, কেউ কি ভাঙছে? হাজতের দরজা খোলা রাখলেও আপনার মতো লোকরা পালাবে না মশাই। হুইচ ইজ ওয়ান থিং আই ক্যান টেল ইউ ফর শিওর।
এই প্রথম আমি বুঝলাম, এঁর কুহক-এলাকা থেকে পালাবার উপায় আমার নেই। নিশ্চিত পরাজয়ের নিশ্চেষ্টতা আমার পাঞ্জায়, উনিও টের পেয়েছে। ধীরে, কিছু বা সস্নেহে, উনি আমার বিফল প্রতিরোধ টেবিলে শুইয়ে দিলেন।
সত্যবান তখন বলে যাচ্ছেন, এই যে ছেড়ে রেখেছি আপনাকে। আইভি সোমের ব্যাপারটা তো সেইজন্যেই জানতে পারলাম। তাই না?
১২. কান্ধা নেহি দেতা
নিজের হাতে কেবিনের পর্দা টেনে দিয়ে আইভি বলল, আমাকে ফোন না করলে হত না।
খুন হয়েছে শনিবার। সোমবার দুপুরে আইভিকে আমি বাম্বু-ভিলায় ওর অফিসে ফোন করে ওয়ান-টানে আসতে বলি। এবং এর বেশি কিছু ফোনে বলিনি। নিশ্চয় কাগজে সব পড়ছে।
যোধপুর পার্ক থেকে ট্যাক্সি নিয়ে লেক গার্ডেনস-এ ঢুকে ল্যান্সডাউন-মার্কেটে আমি ট্যাক্সি ছেড়ে দিই। ফোর-সেভেন এক্সচেঞ্জের বুথ থেকে ডায়াল করেছি। কেউ আমাকে ফলো করেনি। কেউ জানবে না।
খুনের কথা শুনতে শুনতে সেই একবার যা একপলক আমাকে দেখে নিয়েছিল আইভি, তারপর আর চোখের দিকে তাকায়নি। আস্তে আস্তেবলে উঠে দাঁড়িয়ে টেনে দিয়েছিল পর্দা, যেন সারা পৃথিবী আমার কথা শুনতে পাচ্ছে, যদিও আমি কথা বলছিলাম ফিসফিসিয়ে, শুধু ওর জন্যে।
আইভি অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। নিজের কাপে চিনি মিশিয়ে নাড়তে লাগল। আমারটায় দিতে ভুলে গেল এই প্রথম।
মাথা নিচু করে সে বলল, তাহলেও…
আইভি থাকে দাদা-বৌদির সঙ্গে। বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেছে। দেখতে দেখতে ৪০ তো হলই। (বিয়ের পর তো আর দাদা দাদা থাকে না। হয়ে যায় স্বামী, জামাই, জামাইবাবু, ভায়রাভাই, এইসব। —আইভি।) এদিকে আমার কাছেও তার পাবার কিছু নেই।