যাই হোক, দরগা না ছাই। বেকার আসা এতদূর, আলো দিতে, এই বাঁশঝাড়ে! ভাগ্যিস, দীপ্তি আসেনি।
নীলবড়ি দিয়ে রঙ করা আয়তাকার সিমেন্টের বেদি একটা। তাকে ঘিরে শুকনো কঞ্চির বেড়া—এক থোকা ধূপ জ্বলে জ্বলে ছাই হয়ে উড়ে গেছে কখন। শুধু ধূপের গোড়াগুলো মাটির ডেলায় গাঁথা। নষ্ট ফুল।
একে ঘিরেই, লালু জানায়, হর সাল জানবারি মাসের প্রথম চাঁদের দিন হয় উর্স–জিন্দা পিরের মেলা, তখন এই দরগার মাথায় চাঁদোয়া লাগে। তখন এই ছোট্ট পাহাড় ঘিরে লোকে লোকারণ্য। সিনিমার তাম্বু পড়ে তখন। উর্স কমিটি এইসান ভারী ভারী হাণ্ডা লিয়ে আসে। খিচুড়ি বানায়। মেলা চলে সাত রোজ। সাত রোজই গোরের মধ্যে বসে মৃত পির আমজনতার সঙ্গে তিন দফে নমাজ আদায় করেন। কোনও কোনও রাতে বাজনার শব্দ ভেসে আসে। কবরের ভেতর থেকে।
বহুৎ সা আদমি শুনা হ্যায়, লাল্লু নামতে নামতে বলতে থাকে, হামারা বাপ-চাচা দোনো শুনা হ্যায়। হাম? মেরা নসিব মে তো আভিতক … লেকিন বাবু, খুদাকা রহম গিরেগা–তব না শুনেগা?
আধাআধি নেমে, পাহাড়ের একটা বাঁক নিতে, নিচে দীপ্তিকে স্পষ্ট দেখা যায়।
টাঙ্গা থেকে রাস্তায় নেমে সে হাত নেড়ে তাড়াতাড়ি নেমে আসতে বলছে। তার অতি ক্ষীণ কণ্ঠস্বরও এখানে ভেসে আসে। অবশ্য, সে নিরাপদ এটা বেশ বোঝা যাচ্ছে। এখনও যথেষ্ট আলো রয়েছে। ঘোড়া ছাড়া ওর ধারেকাছে কেউ বা কিছু নেইও। হয়ত সাপটাপ। দেখেছে বড়জোর।
আমার মুখ জুড়ে তবু আশঙ্কার ছায়া ঘনিয়ে আসে।
জলদি আ-ও লাল্লু।–আমি বলি।
হাঁ! হাঁ, বাবুজি। চলিয়ে।
তারপর পাহাড় থেকে দ্রুত পায়ে নামতে নামতে, ঘোড়ার রাগী ছপটি দিয়ে ভেঙে একটা আকন্দের ডাল, হঠাৎ, কেন কে জানে, আমার উদ্দেশে লালু ওই বাক্য কটি বলে। যে, বহু, বাবুজি.. লেকিন কান্ধা নেহি দেতা।
ও যা বলতে চায় তার ভাবার্থ শোনামাত্র টের পাইনি, এমন কথা বলব না। কিন্তু, কান্ধা শব্দটি ইতিপূর্বে শোনা না থাকায় আমি খুব নিশ্চিত হতেও পারছিলাম না।
কান্ধা?
আমি দাঁড়িয়ে পড়ে ওর কাছে জানতে চাই।
কান্ধা বাবুজি?
উত্তরে বাঁহাতের তর্জনী দিয়ে বাম কাঁধে টোকা মেরে সে ইঙ্গিত করে। তারপর কাঁধের পাশে হাতের মুঠি রেখে, হাসতে হাসতে, যেন হাতে কিছু ধরে আছে এমন ভাবে, একটা কিছু দোলায়। আমার চোখের সামনে চুনারের যুবক টাঙ্গাওয়ালা মুহূর্তের জন্য রূপও পোশাক বদল করে যেন এই মুর্দা-গাঁওয়ের এক শববাহকে পরিণত হয়। (ইয়ে তো মুর্দা গাঁও হ্যায় বাবুজি, কিতনা ফাইট হুয়া হ্যায় হিয়া পে, ইস চুনার মে। আপ তো সব কুছ জানতে হোঙ্গে।) কালো পাথর থেকে কুঁদে বের করা তার মুখের অগণন বসন্তক্ষতের মধ্যে সর্বজ্ঞ বৃদ্ধের দন্তহীন আবিল হাসি জমা হতে আমি দেখি।
আমি বেশ ভয় পাই। তাকে দেখে।
দীপ্তি রাগ করেছে। কিন্তু রাগ করে, না বুঝে, সে বসে পড়েছে এ কোথায়? না, একটি চারকোণা পাথরের ওপর। এটাও কি একটা কবর হতে পারে না?
যদি পুরুষের কবর হয়, এর স্ত্রীও শবানুগমন করেনি। কান্ধা দেয়নি। আমার মনে হল।
সেবার কাশীতে আমরা উঠেছিলাম পাড়ে হৌলিতে। সে অনেক বছর আগের কথা। তখনও আমাদের বিয়ের বছর ঘোরেনি।
বাঙালি ভদ্রলোকের আটপৌরে হোটেল। নাম সেন লজ। জানালার নিচে দিয়ে চৌষট্টি যোগিনী ঘাটের সিঁড়িশ্রেণী নেমে গেছে। দুদিকে বাড়িঘর, দেওয়াল। তার মধ্যে দিয়ে এক চিলতে প্রায়ান্ধকার গঙ্গা দেখা যায়। পাল-তোলা একটি বজরা গেলে, বোঝা যায়। ওপারে রামনগরের আলো।
ব্রিজে একটা মালগাড়ি ঢুকেছে। যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আমি বলি, ওই যে টাঙ্গাওয়ালাটা, চুনারের। মুখটা আজ আমাকে কি বললে জানো দীপু?
দিনের তুলনায় রাতে এখানে দিব্যি শীত। হোটেল থেকে কম্বল ও খেশ দুই-ই দিয়েছে। অর্থাৎ রাতে খেশ, ভোরে কম্বল। যদি ভোরে ভুলে যায়, দীপ্তি এখন থেকেই কিছুটা কম্বল টেনে নিয়েছে।
দু-দুটান ধোঁয়া ছেড়েও উত্তর এল না দেখে আমি স্বতঃপ্রণােদিত হয়ে বাকিটা বলে ফেলি।
ওই পিরের কবর দেখে নামছি যখন। ব্যাটার হাজার পাঁচেক বছরের ভারতীয় মুণ্ডু বলে কিনা, বহু বাবুজি, মানে বৌ আর কী…
বৌ আর কী?
বললে, স্ত্রীরা সব দিতে পারে স্বামীর জন্যে। এমনকি জানও দিতে পারে। কিন্তু তারা কান্ধা দেয় না।
তার মানে?
কান্ধা মানে, ওই কাঁধ আর কী!
মানে? কী বলতে চাইছে ও?
হায় রে অভিমানিনী নারী! এরও মানে? এখনও প্রাঞ্জল হল না? দীপ্তি কি কখনও নিজে কিছু ভাববে না! ভাববার যা, ফ্রয়েড আর ইয়ুং, ম্যাকদুগাল আর টিচনার, আগেই ওর হয়ে ভেবে রেখেছে।
তবে, অশিক্ষিত খোট্টা টাঙ্গাওয়ালা কী-আর এমন বলে থাকতে পারে যা না জানলে দীপ্তির চলবে না। আমি বুঝিয়ে বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু, আমাকে বাধা দিয়ে সে বলল, উহুহু।অর্থাৎ, শীত। তারপর বলল, তোমার সিগারেট খাওয়া হল?
অর্থাৎ, রাতের মেলামেশা করার যদি ইচ্ছা থাকে, ঝটপট এস। জলদি কর। লাল্লু কী ছাই-পাঁশ তোমাকে বলেছে, সেগুলো শোনানোর মতো কোনও কথা নয়। ভাববার মতো ভাবনা নয়। এখন ভাবনার বিষয় হল, আমার ঘুম। এবং, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। জীবনে
যে যত বেশি ঘুমোতে পেরেছে, তার তত জিত। এবং যার ঘুমে যত কম স্বপ্ন।
ব্লাউজের পিঠের দিকের হুক খোলায় তার সঙ্গে দাম্পত্য সহযোগিতা করার ফাঁকে আমি সাদা বাংলায় ওকে, একটু দেরিতে হলেও, এবার পুরোটা শুনিয়ে দিই, মানে হল গিয়ে, স্ত্রীরা। আর কি, স্বামীর শবযাত্রার সঙ্গী হয় না। লাল্লু বলছিল। তারা শ্মশানে যায় না।