লালপাহাড়ির দেশে যা
রাঙামাটির দেশে যা
হেথায় তোরে মানাইছে না গ
ইক্কেবারে মানাইছে না গ…
আমাদের দলটা ছিল মূলত ব্যাঙ্কারদের। কিন্তু রাত বাড়লে বার-এব্রাহ্মণে-চণ্ডালে কোনও ভেদাভেদ থাকে না। আমরাও উঠে গিয়ে লাস্ট রাউন্ড হাতে ওঁদের সঙ্গে গলা মেলাতাম। তা, ওঁদের মুখেও তো কোনওদিন জেমস জয়েস শুনিনি।
কোনওদিন কথা হয় দেশের অবস্থা নিয়ে, কোনওদিন টিভি সিরিয়াল। ওঁর কথাবার্তার লেভেল নিঃসন্দেহে উঁচু মানের। রীতিমতো ইন্টেলেকচুয়াল। মহাভারত বিষয়ে ওঁর বক্তব্য হল–এই সিরিয়ালের আসল উদ্দেশ্য হল, হিন্দু ফান্ডামেন্টালিস্টদের একটা প্ল্যাটফর্মে এককাট্টা করা। সারা ছবি জুড়ে শুধু পিতাশ্রী, ভ্রাতাশ্রী, মাতাশ্রী মায় মামাশ্রী। আগাগোড়া চেস্ট তদ্ভব হিন্দি। বিজয়ী ভব আর চিরঞ্জীবী ভব–ভাঞ্জে, অতহ, অ্যান্ড পরন্তু! লক্ষ্য করেছে কি, একদম বলেই দেওয়া হয়েছে স্ক্রিপ্ট রাইটারকে, ডায়ালগে যেন, খবর্দার, একখানা মোচরমান শব্দও না থাকে!
দেশের অবস্থার কথা বলতে গিয়ে উনি যা বললেন, তার মর্মার্থ ভারতবর্ষের কপাল এখন, অবশেষে, সত্যি পুড়ছে এবং চচ্চড়িয়ে।
রাজা নবম চার্লসের সময়, বুঝলেন, সেই কোন সিক্সটিনথ সেঞ্চুরিতে, উনি সিগারেট ধরালেন, একবার অ্যান্টার্কটিক থেকে চারটে ক্যানিবালকে ধরে আনা হয়। শহরের জৌলুস। আর রাজকীয় জাঁকজমক দেখিয়ে ইন্টারপ্রেটার মারফত রাজা তাদের কাছে জানতে চাইলেন, সব তো দেখলে। এখন বল, কোনটা তোমাদের সবচেয়ে বেশি অবাক করল?
সভ্যতার সঙ্গে সেই তাদের প্রথম সংস্পর্শ! বোকাহাঁদা নরখাদকরা বলল, তারা তিনটে অবাক কাণ্ড দেখেছে। তারা কী বলেছিল জানেন? তৃতীয়টা, আমি ভুলে গেছি। কিছুতেই মনে পড়ে না। কোথায় যে পড়েছিলাম। বইটার নামও মনে নেই।
প্রথমটা কী ছিল?
তারা বলেছিল, দ্যাখো রাজা, আমরা প্রথমত অবাক হয়েছি তোমার মতো একটা পুঁচকে ছেলেকে এইসব সা-জোয়ান লোকগুলো (সশস্ত্র গার্ডদের দেখিয়ে)নতজানু হয়ে কুর্নিশ করছে কেন? তারা তোমাকে কাঁচা খেয়ে ফেলে নিজেদের মধ্যে কারুকে সিংহাসনে বসাচ্ছে না কেন?
আমার এত বড় দুঃসময়েও একটু না হেসে আমি পারিনা, তারপর? রাজা নিশ্চয়ই দ্বিতীয় প্রশ্ন আর করেননি?
না-না। রাজা তো বাচ্চা ছেলে। দ্বিতীয়ত, তারা বলেছিল, শহর ঘুরে তারা দেখল, কিছু লোক প্রাসাদে থাকে আর বেশি লোক ফুটপাতে। কিছু লোক সেঁড়েমুসে খায়। বাকি লোক খেতে পায় না। কিছু লোক গাড়ির ওপর। কিছু লোক তাদের টানতে টানতে ধুকছে। কই, তাদের দেশে তো তারা এমনটা কোথাও দেখেনি।
সত্যবান আর-একটা সিগারেট ধরালেন।
আসলে কী, ওদের দেশে তো আমাদের মতো পুলিস নেই। বিচার নেই, আইন নেই, তাই জেলখানাও নেই। ব্যবসা-বাণিজ্য কী তারা জানে না। তাদের ধনসম্পদ নেই, তাই দারিদ্রও নেই। প্রভু নেই, অতএব চাকরও নেই। এরা তো সব নন-স্টার্টার–হাঃ হাঃ–এদের খেলায় হারজিত নেই। এরা তো সব ন্যাংটা, হোঃ হোঃ, এখানে বাটপাড় কোথায়। লোভ, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, উচ্চাভিলাষ, দম্ভ, চরিত্রহনন—এই সব শব্দের যারা… যারা… যাদের প্রতিনিধি, কী বলবেন তাদের, এক কথায় স্বাস্থ্যবান নপুংসক বলা যাক? এই জিনিসটা–এই পুরুষত্বহীনতা–এ তো তাদের মধ্যে জন্মই নেয়নি।
সেদেশে বেশ্যা নেই। তারা রাজাকে বলেছিল। কারণ, নারীর পূর্ণ যৌন স্বাধীনতা সেখানে আছে। কুমারী মাতা সেখানে সন্তান হত্যা করে না–বাবু! বলা শেষ হয়েছে বলেই কি সত্যবান এখানে চুপ করলেন, নাকি এখানে শেষ করবেন বলেই আজকের টপিকটা শুরু করেছিলেন? (পরে বুঝেছি, উনি তখন মারি স্টোপস ক্লিনিকে ভ্রণ-হত্যার ব্যাপারটা জানতেন। জানবারই কথা।)
ক্যানিবালদের তৃতীয় উত্তরটা কী ছিল, সে সম্পর্কে অবগত হবার কৌতূহল অচরিতার্থ রেখে আমি উঠে পড়লাম। এক ঘণ্টা হয়ে গেছে। আজকের মতো ছুটি। সেদিনও আসল কথা কিছুই বললেন না সত্যবানবাবু।
বেশ চলছিল। কিন্তু আজ, দ্বাদশ দিনে, উনি এমন একটা সাবজেক্ট নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করলেন যে হা-হুঁ করা দূরে থাক, শ্রুতিমাধ্যমে তাতে অংশগ্রহণ করাও আমার পক্ষে আর সম্ভব হল না।
আজ সত্যবান শুরু করলেন পুলিস-টর্চার নিয়ে।
ধরুন, ধোঁয়া ছেড়ে, কনফেশান আদায়ের এই যে পুলিসি মেথডলজিটা। অত্যাচার, টর্চার—এটা..এটা কি ইন ইটসেলফ সাব-হিউম্যান নয়? ধোঁয়া ছেড়ে, আপনি সহ্য করছেন, সহ্য করছে……করছেন, করছেন, করছেন, করছেন—ব্যস, তারপর আর পারলেন না।বলে ফেললেন! অনেক ক্ষেত্রে সলিটারি কনফাইনমেন্টও দেওয়া হয়। একদিন, সাতদিন, একমাস পরে আপনি বলবেন, আমাকে মুক্তি দাও এই নিঃসঙ্গতা থেকে। হ্যাঁ, আমি খুন করেছি।জানেন। কি, খুনের পর খুনিরা কখনও একা থাকে না? তারা মানুষের ভিড়ে মিশে থাকে? ধোঁয়া ছেড়ে, ক্রিমিনোলজিস্টরা বলবেন, এখানে খুনির বিবেক শেষ পর্যন্ত কথা বলল। তাই কি? ধোঁয়া ছেড়ে, আমি অনেক খুনিকে হ্যান্ডেল করেছি। আমি জানি, খুন করার পর খুনির পৃথিবী দুভাগে ভাগ হয়ে যায়। একটায় থাকে সে, আর একটায় থাকে বাকি পৃথিবী। খুনির পৃথিবীতে ওসব বিবেক-ফিবেক থাকে না। বানের তোড়ের বিরুদ্ধে বিষধরের ফণা জেগে থাকা দেখেছেন কখনও, বাবু? ভেসে যেতে যেতে খুনির মধ্যেও ওভাবে জেগে থাকে একটাই চেতনা আর তা হল—রাইট টু লিভ। ধোঁয়া ছেড়ে, মৃত্যু পর্যন্ত দড়িতে ঝুলতে যাবার আগে প্রত্যেকটি খুনি সেই মানবতাবাদী ফাঁসুড়েদের অভিসম্পাত দিয়ে গেছে–আমরা যাদের গালভরা নাম দিয়েছি—বিচারপতি! সহ্যশক্তির তো একটা শেষ আছে। ব্রেকিং পয়েন্টে হ্যাঁ বলায় কত নিরাপরাধকে যে খুন করেছে ওই বিচারপতিরা, তার হিসেব কে রেখেছে?