খুব না বলে, বলা উচিত, তিনি মুহুর্মুহু সিগারেট খান।
যার-পর-নেই মৃদু ও মার্জিত ভাষায় যিনি আমাকে প্রথম সাক্ষাতেই বলেছিলেন, আপনি কনফেস করুন, আজ ১১ পেরিয়ে ১২ দিন হতে চলল, সেই তিনি আমাকে এখনও অ্যারেস্ট করেননি।
দীপ্তির মৃত্যুর পর ওর জন্যে শোক করা দূরে থাক, ওকে নিয়ে একটা মিনিটও ভাববার সময় পাইনি। আর ভাববই বা কী করে। ওকে নিয়ে একটা কিছু ধরে ভাবতে গেলেই এক শব্দহীন বিস্ফোরণ হয় মাথার মধ্যে। দুঃস্বপ্নে যেমন, একটা থেকে একটা থেকে আর একটা, অন্য থেকে অন্য থেকে অন্য ভাবনা-জগৎ তার মধ্যে ঢুকে পড়ে। পরমাণুর চারিদিকে দুর্ভাবনার ইলেকট্রন মেঘ যেন, যার মধ্যে রয়েছে পরম-পরমাণু অনির্ণেয় কোয়ার্ক এবং অ্যান্টিকোয়ার্কের মতো মাসহীন ভরশূন্য মৌলকণা, যারা, তত্ত্বের খাতিরে, মহাবিশ্বের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত ভ্রমণ করতে পারে—যদি তার প্রান্ত থেকে থাকে। গত দশ বারো দিনে এই দুর্ভাবনার জগৎ আমার অভ্যস্ত ভাবনা-জগৎ থেকে অনেক, অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। সুপরিচিত ইমেজ থেকে এখানে জেগে ওঠে স্বেচ্ছাচারী আবেগ, আবেগের স্বেচ্ছাচার থেকে জন্ম নেয় ইমেজের স্বাধীনতা। এরা আমাকে লুটিয়ে টেনে নিয়ে চলে। এ উন্মত্ততার মধ্যে বেশিক্ষণ বেঁচে থাকার সাধ্য আমাদের অনেকেরই নেই।
এমনিতে ঠিক আছি, কিন্তু, দীপ্তিকে নিয়ে কোনও ভাবনার শুরু হলেই, এমনটা হয়। আজ ফেরার সময় এসপ্ল্যানেড স্টেশনে দরওয়াজা বন্ধ হো রহা হ্যায় শুনতে শুনতে মেট্রো রেলের উজ্জ্বল সন্ধ্যা কখন যে পরিণত হয়ে গেল কবেকার কোনও এক শীতের ভোরবেলায়…দীপ্তির গলায়, এই, তোমরা কে কে চা খাবে উঠে পড়, এর পর সাড়ে আটটার আগে আর চা হবেনা দিয়ে যে বিশ্বাসযোগ্য ভাবনার শুরু হল, মুহূর্ত পরে খেয়াল হতে দেখি, সেটাই আমার জীবনে সূর্যাস্ত তো দিনে একটা হয় না। অনেক সূর্যাস্ত হয় সারাদিনে। এই যেমন এখুনি একটা হল। সব অন্ধকার হয়ে গেল। কিন্তু এখন তো দুপুরবেলা …এই ভয়াবহ জলপ্রপাতের পরিণতিকামী খরস্রোত ধরে কুটোর মতো ভেসে চলেছে।
নাআ!
সহযাত্রীদের চমকে দিয়ে চিৎকার করে উঠে আমাকে তা থামাতে হয়। ট্রেন তখন আমার গন্তব্য ছাড়িয়ে পরবর্তী ও অন্তিম স্টেশন টালিগঞ্জ–এই ঘোষণার মধ্যে! ল্যাম্পপোস্টের দড়ির আগুনে সিগারেট ঠেকাতেই একদিন গানের স্কুল থেকে বেরিয়ে আসা আমার মেয়ের পা-দুটি জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ছি দেখি। তার হাতে স্বরলিপির খাতা। সেখান থেকে শুরু হয়। তারপর একটা থেকে একটা থেকে একটা। অন্য থেকে অন্য থেকে অন্য। স্বাধীন ইমেজ ও আবেগের অসহ্য স্বেচ্ছাচার।
নৃপেনের যোধপুর পার্কের বাড়িতে দীপ্তির শ্রাদ্ধ-শান্তি নমোনমো করে চুকে গেছে। আত্মীয়স্বজন যারা এসেছিল, সকলের, দৃষ্টিভঙ্গি দেখছি একটাই। যে, যে যাবার, সে গেছে। এখন যা আছে, তাকে বাঁচাও। অর্থাৎ, আমি আর চৈতি। নৃপেন তো এটাকে স্লোগান বানিয়ে ফেলেছে। তার শুধু একটাই জিজ্ঞাসা। খুন হল দুপুরে। আমি ফিরলাম রাত ৯টায়। অফিসে যাইনি। আমি তাহলে সারা দুপুর ছিলাম কোথায়?
প্রাইমারি স্টেজে মার্ডার কেস আমার কোর্টে অনেক এসেছে। স্ট্রং আলিবাই থাকলে মামলা কখনও হায়ার কোর্টে পাঠাইনি। নৃপেন বেশ কবার আমাকে জানিয়েছে।
দীপ্তি বসুরায় খুনের ঘটনায় কেউ এখনও অ্যারেস্টহয়নি। এ নিয়ে কাগজে খুব লেখালেখি হচ্ছে। নৃপেনের মুখে শুনলাম, সত্যবান মণ্ডলের ক্ষেত্রে এমনটা আগেও হয়েছে। এ তো সবে ১১ দিন, বাসনা সেন মার্ডার কেসে সে নাকি ছিল দেড় মাস চুপচাপ। তারপর একদিন খপ করে ওদের পুলিসেরই এক আই পি এস-কে ধরল। অকাট্য প্রমাণ হাতে আসার আগে। সত্যবান কখনও সাসপেক্টকে কাঠি দিয়েও ছোঁয় না-নৃপেন জানিয়েছে। তাকে ছেড়ে রাখে। ওয়াচ করে। আই জি ক্রাইমের অগাধ আস্থা ওর ওপর।
চৈতির অবস্থাও আমার মতো। মাতৃশোক ওকে এখনও স্পর্শ করেনি।
যখনই যা কথা হয়, টেলিফোন আসে, চৈতি পাশে দাঁড়িয়ে প্রত্যেকটি কথা শোনে। সিলেবেল ভাগ করে তীক্ষ্ণ স্বরে সে জানতে চাইল, কিন্তু। আমার। বাবা তো। খুন। করেনি।
তা তো করেইনি মামণি। নৃপেন সাদরে হাত ধরে ওকে কাছে টেনে আনে, সে তো আমি জানি। আর সেইজন্যেই তো তোমার বাবাকে এখনও ধরেনি।
এখনও? চৈতি মিস করলেও, আমি শব্দটির প্রয়োগ লক্ষ্য না করে পারি না।
রোজ সকালে সাড়ে ১১টার সময় লালবাজারে সত্যবান মণ্ডলের কাছে আমাকে একবার হাজিরা দিতে হয়। আমি রোজ ঘণ্টাখানেক বসে থাকি। উনি চা খাওয়ান। কোনওদিন লিমকা। আসল কথা একটাও হয় না।
শেষ সিগারেটটা আমাকে ধরিয়ে দিয়ে, দারওয়াজা বলে ডেকে একসঙ্গে পাঁচ প্যাকেট উইলস ফিল্টার আনতে দিয়ে, প্রথম দিনটা উনি কাটিয়ে দিলেন শুধু সিগারেট খাওয়ার অপকারিতা নিয়ে কথা বলে। প্রথম দিনেই নামটা ভুলে গেছেন এমন একজন ইটালিয়ান লেখকের একটা বই রেফার করলেন, জেমস জয়েস তাকে ইংরেজি শেখাতেন, বললেন, বইটার নাম দা কনফেশন অফ জেনো, ওঁর মনে পড়ল। প্রতি রাত্রে শেষ সিগারেট খেয়ে জেনো ডায়েরি তে লিখে রাখত, আর সিগারেট নয় এবং পরদিন ভোরে উঠেই দিনের প্রথমটি ধরাত। তার ডায়েরিতে প্রতিদিন, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর শুধু ওই একটা সেনটেন্স : নো মোর সিগারেট!
পুলিস অফিসারের মুখে জেমস জয়েস শুনে, সত্যি কথা বলতে কি, আমি প্রথম দিন ওঁকে চালবাজ ভেবেছিলাম। কিন্তু, পরে ধারণা পাল্টাতে হয়। আমি অটোমোবিল ক্লাবের মেম্বার। এক সময় ওখানে খুব আসতেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও তাঁর দলবল। রাত বাড়লে। সুনীলবাবু গান ধরতেন।