কীরকম কাজ হল? ক্যাপ্টেন কৃষ্ণণ জিজ্ঞেস করলেন। খুব ভাল। তবে সকালের নালার কাজের চেয়ে ভাল নয়। একটা কথা বলছি তোমায়, বললেন কৃষ্ণণ, আমাকে এবার থেকে কেষ্টদা বলে ডাকবে। ওটাই আমার আসল নাম। তোমাদের কাছে তো নিজেকে মাদ্রাজি বলে পরিচয় দেবার কোনও কারণ নেই।
এই ভাল। আমার নিজেরও ক্যাপ্টেন কৃষ্ণণকে দাদা বলতে ইচ্ছা করছিল, কিন্তু কীভাবে শুরু করব সেটা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।
একটা কথা জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে ছিল, সেটা এই বেলা বলে ফেললাম।
তুমি কী করে এই স্টান্টম্যানের কাজে ঢুকলে কেষ্টদা?
সে অনেক ব্যাপার, বলল কেষ্টদা, আমি পণ্ডিতের বাড়ির ছেলে। আমার বাড়ি কোন্নগর। বাপ ছিলেন ইস্কুলে সংস্কৃত আর অঙ্কের মাস্টার। বোধহয় এখনও আছেন। আমি ছিলুম ইস্কুল-পালানো। ছেলে। ক্লাস কামাই করে হিন্দি ফাইটিং-এর ছবি দেখতে যেতুম, আর বাবার কাছে বেদম মার খেতুম। লাঠির বাড়ি। কিন্তু তখনই একটা কায়দা শিখেছিলুম; পিঠে লাঠি পড়লেও তেমন ব্যথা লাগত না। আমার বাবা যে খুব ষণ্ডা লোক ছিলেন তা না। সে ছিলেন আমার ঠাকুরদা। তিনিও সংস্কৃতের পণ্ডিত, কিন্তু ব্যায়াম করতেন রেগুলার। মুগুর ভাজা। একবার একটা মেড়া শিং বাগিয়ে তাড়া করেছিল ঠাকুরদাকে। উনি উলটে মেড়ার দিকে তেড়ে গিয়ে তার শিং দুটো ধরে মট করে ভেঙে দেন। বুঝে দেখো কেমন জোর। আমিও ব্যায়াম করেছি, তবে বেশি মাসল হলে স্টান্টের ব্যাপারে অসুবিধা হয়। বডিটা হবে স্প্রিং-এর মতো। মাটিতে পড়ার সময় হাড়গোড় সব আলগা দিতে হবে, তাতে হাড়ে চোটটা কম লাগবে। কম করে পাঁচশো বার পড়েছি ঘোড়ার পিঠ থেকে গত দশ বছরে। চোট যে একেবারেই লাগেনি তা নয়; সারা গায়ে ছড়ে যাওয়ার দাগ রয়েছে। কিন্তু শটের সময় কেউ কোনওদিন বুঝতে পারেনি চোট লাগল কিনা।
কেষ্টদা একটু থেমে একটা সিগারেট ধরিয়ে আবার শুরু করল।
তেরো বছর বয়সে ইস্কুল ছাড়ি। বাবা হাল ছেড়ে দেন। আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতায় গিয়ে শেয়ালদার টাওয়ার হোটেলে বয়ের কাজ নিই। পাঁচ বছর সেই কাজ করে একশো ছাপ্পান্ন টাকা জমিয়ে একদিন ফস করে থার্ড ক্লাসের টিকিট কিনে বম্বে মেলে উঠে পড়লুম। দুদিন লাগল বম্বে পৌঁছতে। গমগমে শহর, কাউকে চিনি না, কেবল জানতুম বম্বে টকিজ। গিয়ে শুনলুম বম্বে টকিজ আর নেই। কোথায় যাব? ঘুরতে ঘুরতে একে-ওকে জিজ্ঞেস করে শেষটায় প্যারোলে রাজকমল স্টুডিওতে গিয়ে হাজির হলুম। শুনলুম বাঙালি ডিরেক্টর স্বদেশ মুখার্জি শুটিং করছেন। সোজা গিয়ে ঢুকে পড়লুম স্টুডিওর ভেতর। চুপ করে একপাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম।
লাকটা যে ভাল ছিল সেটা এই ঘটনাটা শুনলেই বুঝতে পারবে। হিরো আর ভিলেনে মারপিটের সিন হচ্ছিল। দুজনের জায়গাতেই স্টান্টম্যান কাজ করছে। হিরোর স্টান্টম্যানকে পেটে লাথি খেয়ে ছিটকে মেঝেতে পড়তে হবে। যেমন-তেমন ভাবে ছিটকে পড়ে যাওয়ার প্র্যাকটিস কলকাতায় থাকতে হোটেলের ছাতে অনেক করেছি। এখানে সেটা কীভাবে হয় দেখবার জন্য লুকিয়ে আছি। যেটা হল সেটা এক কেলেঙ্কারি ব্যাপার। হিসেবের সামান্য গণ্ডগোলে ছিটকে পড়ার সময় হিরোর স্টান্টম্যানের মাথাটা লাগল একটা টেবিলের কোণে। ব্যস, ব্ল্যাক আউট। তাকে চ্যাংদোলা করে সেট থেকে বার করে নিতে হল। এদিকে ডিরেক্টরের মাথায় হাত, প্রোডিউসারের মাথায় হাত। স্টান্টম্যান ছাড়া কাজ বন্ধ হয়ে যাবে। একদিন বন্ধ হলে বিশ হাজার টাকা লোকন। যা থাকে কপালে করে ডিরেক্টরের কাছে গিয়ে ধরে পড়লুম। ভাঙা ভাঙা হিন্দি-ইংরিজি মিশিয়ে বললুম, আমার নাম উন্নি কৃষ্ণণ, আমি মালাবারের লোক, স্টান্টম্যান। আমাকে দিয়ে পরীক্ষা করা হোক।
এমনই সংকটের অবস্থা যে আমি যে কাউকে না বলে শুটিং দেখতে ঢুকেছি, তার জন্য কেউ কিছু বলল না। ডিরেক্টর সাহেব তক্ষুনি বললেন যে, একে নিয়ে একটা রিহার্সেল হোক, উতরে গেলে একে দিয়েই কাজ করানো হবে।
দাঁত কামড়ে নেমে পড়লুম। রিহার্সেল পার্ফেক্ট, টেক পার্ফেক্ট। সেইদিন থেকে স্টান্টম্যান ক্যাপ্টেন কৃষ্ণণের জন্ম। তবে এটা জেনেছি যে একাজে নাম হয় না। ফাইটিং-এর ছবি দেখে কেউ জিজ্ঞেসও করে না কে স্টান্টম্যান ছিল। তবে পেট চলে যায়, কারণ কাজের অভাব নেই। যত দিন যাচ্ছে, ছবিতে স্টান্ট ততই বেড়ে যাচ্ছে। একটা ছবিতে হেলিকপ্টারের তলায় দড়ি ধরে ঝুলতে হয়েছিল। ওয়ান স্টান্ট, টোয়েন্টি ফাইভ থাউজ্যান্ড রুপিজ। প্রাণ হাতে নিয়ে কাজ করা তো! প্রতি স্টান্টেই জান লড়িয়ে দিতে হয়, কারণ একটু এদিক-ওদিক হলেই, মৃত্যু না হোক, মারাত্মক জখম হতেই পারে। দেখলেই তো সকালে, ব্যাপারটা কত রিস্কি। একটু গড়বড় হলে কী হত ভাবতে পারো?
ভাবতে পারি, কিন্তু ভাবতে চাই না। আমি জানি যে আমার ভাগ্যটা এখন লটকে গেছে কেষ্টদার ভাগ্যর সঙ্গে। সেখান থেকে পিছোনোর কোনও উপায়ও নেই, ইচ্ছেও নেই।
পাহাড়ের পিছনে সন্ধ্যার আকাশ থেকে শেষ রঙটুকু মুছে গেল। লেকের জল কালচে নীল। হাঁসগুলিকে এখনও দেখা যাচ্ছে, একটু পরে আর যাবে না। ভিতরে সকলে তাস খেলতে বসে গেছে। সেটা মাঝে মাঝে হই-হুল্লোড় থেকে বোঝা যাচ্ছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি তাস খেলো না কেষ্টদা?