রেডি হলে বলবেন! হাঁক দিল বিশুদা।
কয়েক সেকেন্ড পরেই উত্তর এল—
রেডি! আই অ্যাম কামিং।
এবার বাইকের শব্দটা ক্রমে বেড়ে যাওয়াতে বুঝতে পারলাম সেটা রওনা দিয়েছে। রওনা দেওয়া, আর ঝোঁপের পিছন থেকে হঠাৎ ম্যাজিকের মতো বেরোনো–এই দুটো অবস্থার মধ্যে ব্যবধান বড়জোর তিন সেকেন্ডের। আর তার পরেই ঘটল তাক লাগানো ব্যাপারটা। একটা হিংস্র, ক্ষুধার্ত বাঘ যেমন তার সমস্ত শক্তি দিয়ে অনায়াসে দশ হাত দূরে তার শিকারের উপর লাফিয়ে পড়ে, সেইভাবে, আর ঠিক সেই রকম সহজে আর সতেজে ক্যাপ্টেন কৃষ্ণণের মোটরবাইক শূন্য দিয়ে লাফিয়ে নালা টপকে উলটোদিকের উতরাইয়ের মুখটাতে পড়ে গড়গড়িয়ে নেমে ওদিকের ঝোঁপের পিছনে অদৃশ্য হয়ে গেল।
এর পরে একটাই জিনিস হবার ছিল, আর হলও তাই। দলের সব কটি লোক একসঙ্গে হাততালি দিয়ে কৃষ্ণণের এই আশ্চর্য স্টান্টের তারিফ করল।
কিন্তু এইখানেই খেলার শেষ নয়। এর পরে যেটা হল সেটা আমি সারাজীবন ভুলতে পারব না। ওপার থেকে হঠাৎ কৃষ্ণণের ডাক শোনা গেল।
মাস্টার অংশুমান।
আমি আমার নামটা শুনে হঠাৎ কেন জানি থতমত খেয়ে গেলাম। অংশুমান যেন আমি নই; নামটা যেন অন্য কারুর।
কোথায়–মাস্টার অংশুমান! আবার এল ডাক।
এদিকে বিশুদা আমার দিকে এগিয়ে এসেছে।
তোকে ডাকছে–তুই যাবি?
যাব।
হঠাৎ মনের সমস্ত ভয় যেন ম্যাজিকের মতো উবে গেল। আমার মন বলল, ক্যাপ্টেন কৃষ্ণণ যেখানে সারথি সেখানে ভয়ের কিছু থাকতে পারে না।
আমি চেঁচিয়ে বলে দিলাম, এক্ষুনি আসছি। তারপর প্যান্ট তুলে নালা পেরিয়ে হাজির হলাম ওপারে। বিশ হাত দূরে ক্যাপ্টেন কৃষ্ণণ বসে আছেন বাইকে; আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকলেন।
রিহার্সালটা হয়ে যাক!
আমি এগিয়ে গেলাম ক্যাপ্টেন কৃষ্ণণের দিকে। ভদ্রলোক ক্যারিয়ারের উপর একটা চাপড় মেরে বুঝিয়ে দিলেন আমায় কোথায় বসতে হবে। আমি বসলাম।
কিচ্ছু ভয় নেই; শুধু আমার কোমরটাকে দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে।
আমি ধরলাম। ক্যাপ্টেন কৃষ্ণণ বাইকটাকে ঘুরিয়ে আরেকটু দূরে নিয়ে গেলেন। তারপর আবার নালার দিকে ঘুরিয়ে এঞ্জিনে একটা হুঙ্কার দিয়ে বাইকটা ছেড়ে দিলেন।
কোমর জড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাই আমি কিছুই দেখিনি, শুধু জানি যে যখন চোখ খুললাম তখন আমি উলটো পারে চলে এসেছি, আমার উপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে গেছে, আর সকলে নতুন করে হাততালি দিচ্ছে আর শাবাশ শাবাশ বলছে।
কেমন লাগল? জিজ্ঞেস করলেন ক্যাপ্টেন কৃষ্ণণ।
আমি বললাম, দারুণ মজা, দারুণ আরাম।
যাক, আর কোনও ভাবনা নেই। কাল স্টেশন থেকে আসার পথে বিশুবাবু বলেছিলেন সিনটার কথা। আমি বললাম, কোনও চিন্তা নেই। ছেলেটি যদি সাহস করে বাইকে চড়তে পারে তা হলে আমার দিক দিয়ে কোনও গড়বড় হবে না।
এর মধ্যে আরও অনেকে আমাদের কাছে এসে পড়েছে। সুশীলবাবু পুষ্করে শুটিং করছেন, নাহলে উনিও নিশ্চয় খুবই খুশি আর নিশ্চিন্ত হতেন। শঙ্কর মল্লিক আমার পিঠ চাপড়ে ব্রেভ বয় বলে তারিফ করলেন, তারপর কৃষ্ণণের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, আমার এই স্টান্টের ব্যাপারে সত্যিই চিন্তা ছিল। জানি আমাকে এসব কিছুই করতে হবে না, কিন্তু যে করবে তাকে মানাবে কিনা সেইটেই ছিল ভাবনা। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আমার মতো একটা গোঁফ লাগিয়ে দিলে একটু দূর থেকে বা পিছন থেকে কেউ আর তফাতই করতে পারবে না।
যে কাজের জন্য আসা হয়েছিল সেটা হয়ে গেছে বলে সবাই আবার বাসে উঠল। বারোটার মধ্যে সার্কিট হাউসে দুপুরের খাওয়া সেরে যেতে হবে মিঃ লোহিয়ার বাড়ি।
নালা টপকানোর ব্যাপারে রিহার্সালটা এভাবে উতরে যাওয়াতে আমার যে কী নিশ্চিন্ত লাগছে তা বলতে পারি না। সমস্ত ছবিটাতে এটাই আমার সবচেয়ে কঠিন কাজ, আর এটা নিয়েই ছিল সবচেয়ে বেশি ভাবনা। ভাগ্যিস কৃষ্ণণকে পাওয়া গিয়েছিল! ভাল স্টান্টম্যান যে কী জিনিস সেটা আজ প্রথম। বুঝলাম।
০৬. লোহিয়ার বাড়িতে দুপুরের কাজ
বিকেল পাঁচটার মধ্যে মিঃ লোহিয়ার বাড়িতে দুপুরের কাজটা হয়ে গেল। আমার মন সবচেয়ে খুশি আছে এই কারণে যে, আমার ভুলের জন্য বারবার একই শট নিতে হচ্ছে না। আমি বুঝেছি যে ক্যামেরার ভয়টা কাটিয়ে উঠতে পারলে কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। হিরো শঙ্কর মল্লিকও প্রথম দিনে ভালই অ্যাকটিং করেছেন। এই একজনের সম্বন্ধে কেউ কিছুই জানত না, কারণ ইনিও নতুন লোক। পরে। শঙ্করবাবু নিজেই বলেছিলেন যে উনি নাকি ছবির পোকা; বহু ভাল বিদেশি ছবিতে বিদেশি অ্যাকটরদের অভিনয় দেখেছেন। তাতে নিশ্চয়ই অনেকটা সাহায্য হয়েছে, কারণ উনি যেটা করলেন সেটাকে প্রায় অ্যাকটিং বলে মনেই হয় না। আজ শুটিং দেখতে এখানকার একজন সত্যিকারের পুলিশ ইনস্পেক্টর ছিলেন। এঁর নাম মিঃ মাহেশ্বরী, মিঃ লোহিয়ার খুব চেনা। তিনি সব দেখে-টেখে খুব তারিফ করে গেলেন।
সন্ধ্যায় সার্কিট হাউসে ফিরে এসে আবার ক্যাপ্টেন কৃষ্ণণের সঙ্গে দেখা হল। সারা দুপুরে আমার অনেকবার মনে হয়েছে ভদ্রলোকের কথা, আর সেইসঙ্গে সকালের তাক-লাগানো ঘটনাটা। এটা জানি যে, মা-বাবা এখানে থাকলে কখনওই এ জিনিস করতে দিতেন না। বিশুদা বলে দিয়েছে–বাড়িতে যখন চিঠি লিখবি, খবরদার এই স্টান্টের কথাটা লিখবি না। ওটা কাকা-খুড়িমা একেবারে ছবি দেখতে গিয়ে জানতে পারবেন, তার আগে নয়। জানলে সব দোষ পড়বে আমার ঘাড়ে।