স্টান্টম্যান-স্টান্টম্যান করছিলি–ইনিই ক্যাপ্টেন কৃষ্ণণ, বলে বিশুদা ভদ্রলোককে আমার পাশের খালি সিটে বসিয়ে দিল। ক্যাপ্টেন কৃষ্ণণ আমার দিকে চেয়ে ঝলমলে দাঁত বার করে হেসে পরিষ্কার বাংলায় বললেন, নমস্কার।
আমি তো অবাক! ভাবতেই পারিনি যে কৃষ্ণণ বাঙালির নাম হতে পারে।
বাসের মাথায় মোটর সাইকেল চড়ে গেছে, দুবার হর্ন দিয়ে ডিলাক্স বাস রওনা দিয়ে দিল।
বাসের সবাই ঘুরে ঘুরে নতুন-আসা স্টান্টম্যানের দিকে দেখছে; আমার চোখটাও চলে গেল তাঁর দিকে। ভদ্রলোক এখনও মিটিমিটি হাসছেন। শেষে আর না থাকতে পেরে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি বাঙালি বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু আপনার নাম তো–?
আমার নাম কৃষ্ণপদ সান্যাল, হেসে বললেন ভদ্রলোক, বম্বেতে বাঙালি স্টান্টম্যানকে কেউ পাত্তা দেয় না, তাই একটা দক্ষিণী নাম নিয়েছি। ওখানে ভাঙাভাঙা হিন্দি আর ইংরেজি বলি। কথা তো বলতে হয় না বেশি–আমাদের কথায় কেউ কান দেয় না, শুধু দেখে কাজটা ঠিক হচ্ছে কিনা!
আমার অদ্ভুত লাগছিল ভদ্রলোককে দেখে। ইনিই শঙ্কর মল্লিক হয়ে সব কঠিন প্যাঁচের কাজগুলো করবেন, আর লোকে ছবি দেখে ভাববে সব বুঝি শঙ্কর মল্লিকই করছেন। বিশুদা বলছিল, হিন্দি ছবির হিরোরা যত ফাইটিং করে, যত ঘোড়া থেকে পড়ে, যত এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি লাফ মেরে চলে যায়–সবই আসলে করে স্টান্টম্যানরা, কিন্তু বাইরের লোকে সেটা জানতেও পারে না।
আমি আরেকবার আড়চোখে চাইলাম ভদ্রলোকের দিকে। কৃষ্ণপদ সান্যাল। তার মানে ব্রাহ্মণ। তাদের বাড়ির ছেলে স্টান্টম্যান হল কী করে? এসব তোতা জানতে হবে ভদ্রলোকের কাছ থেকে। এটা বেশ বুঝছি যে, একে একটা গোঁফ লাগিয়ে দিলে একটু দুর থেকে শঙ্কর মল্লিকের সঙ্গে বেশি তফাত করা যাবে না। দুজনের গায়ের রঙ আর গড়ন মোটামুটি একই রকম। বিশুদার বাছাইয়ের প্রশংসা করতে হয়। সে-ই যে এই স্টান্টম্যানকে জোগাড় করে এনেছে সেটা জানি।
তোমার নাম কী?
নাম বললাম। তারপর বললাম, আমাকে তো বোধহয় আপনার পিছনে বসতে হবে মোটরবাইকে।
তা বসবে, বললেন ক্যাপ্টেন কৃষ্ণণ, ভয়ের কোনও কারণ নেই। মোেটর সাইকেলের স্টান্ট আমার মতো কেউ করতে পারে না। বাইশটা হিন্দি-তামিল ছবিতে আমি মোটর সাইকেল চালিয়েছি, একবারও গড়বড় হয়নি।
তাই বুঝি?
ইয়েস স্যার।
ভদ্রলোককে দেখে কেন জানি বেশ ভাল লাগছিল। চেহারার মধ্যে এমন একটা নির্ভীক ভাব চট করে দেখা যায় না। আর এমন পরিস্কার হাসি যে মানুষের, তার মধ্যে কোনও নিচুভাব থাকতে পারে কি? মনে তো হয় না।
ক্যাপ্টেন কৃষ্ণণ গুনগুন করে হিন্দি গানের সুর ভাঁজছেন দেখে আমি আর কোনও কথা বললাম না। ভাল করে আলাপ করার অনেক সময় আছে। নালা টপকানোর শুটিংটা হবে দুসপ্তাহ পরে, সেটা আমি জেনে নিয়েছি।
দৌরাল একটা ছোট্ট শহর। সেটা ছাড়িয়ে বাস আরও কিছুদূর যাবার পর বিশুদা এক জায়গায় থামতে বলল। বাঁয়ে বনের মধ্যে দিয়ে একটা পায়ে হাঁটা পথ চলে গিয়েছে। বুঝতে পারলাম সেটা দিয়ে আর বাস যাবে না, আর সেটা দিয়েই আমাদের যেতে হবে। এইসব জায়গা বাছার জন্য সুশীলবাবু বিশুদা আর ক্যামেরাম্যানকে সঙ্গে নিয়ে গত মাসেই একবার আজমীর ঘুরে গেছেন। জায়গা বাছার কাজটা সবসময় আগেই সেরে নিতে হয়; শুটিং একবার আরম্ভ হয়ে গেলে তখন আর অন্য কিছুর সময় থাকে না। এই নালাটা ডিরেক্টর সাহেবের পছন্দ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু যাকে মোটর সাইকেল করে এটা টপকে পেরোতে হবে তারও তো পছন্দ হওয়া চাই!
বিশুদা বলল, জায়গাটা বড় রাস্তা থেকে মিনিট পাঁচেকের হাঁটাপথ। জিপে করে অনায়াসেই যাওয়া। যায়, এমনি গাড়ি বা বাসে সম্ভব নয়।
আমরা বাস থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করলাম। মোটর সাইকেলটাও নামানো হয়েছে; ক্যাপ্টেন কৃষ্ণণ তাতে চড়ে বিকট আওয়াজ তুলে স্টার্ট দিয়ে আমাদের পাশে-পাশেই চললেন।
পাতলা বন, গাছ পালাগুলো সব অচেনা, এ দৃশ্যের সঙ্গে আমাদের বাংলাদেশের কোনও মিল নেই। ক্রমে বড় রাস্তার গাড়ি চলাচলের শব্দ একেবারে মিলিয়ে এল। এখন শুধু মোটর সাইকেলের শব্দ আর পাখির ডাক।
মিনিটখানেক পরে একটা কুলকুল শব্দ পেলাম। বুঝলাম নালা এসে গেছে। এখানে পথটা একটু চওড়া আর একটু চড়াই। খানিকদূর চড়াই গিয়ে রাস্তাটা হঠাৎ ঢালু নেমে গিয়ে একেবারে নালায় পড়েছে। নালাটা হাত দশেক চওড়া হলেও মোটর সাইকেলকে লাফিয়ে পার হতে হবে প্রায় বিশ পঁচিশ হাত, তা হলে ঠিক এদিকে চড়াই-এর মুখ থেকে ওদিকে উতরাইয়ের মুখে গিয়ে পড়বে।
কী কাপ্তেন, কী মনে হচ্ছে?
বিশুদা ক্যাপ্টেন কৃষ্ণণের দিকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল। কৃষ্ণণ ইতিমধ্যে বাইক থেকে নেমে সেটাকে দাঁড় করিয়ে নালা আর রাস্তাটাকে ঘুরে ঘুরে দেখছে।
দাঁড়ান, একবার ওপারটা দেখে আসি।
কৃষ্ণণ ঢাল দিয়ে নেমে জলের ধারে গিয়ে প্যান্টটাকে গুটিয়ে খানিকটা উপরে তুলে ছপ ছপ করে জল পেরিয়ে ওপারে চলে গেলেন। মিনিটখানেক ওদিকটা দেখার পর আবার এদিকে ফিরে এসে বললেন, আমি একবার ট্রাই করে দেখব। আপনারা একটু পাশে সরে দাঁড়ান।
দলের সবাই হুড়মুড় করে নালার ধারে নেমে রাস্তার দুপাশে ভাগ হয়ে দাঁড়াল। আমি বাঁ দিকের দলের সঙ্গে রয়েছি, আমার চোখ রাস্তার দিকে। কৃষ্ণণ ইতিমধ্যে আবার ওপরে ফিরে এসে মোটর সাইকেলের দিকে এগিয়ে গেছে। রাস্তার দুপাশে ঝোঁপ থাকার জন্য কৃষ্ণণকে আর দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু ফটফটানি শোনা যাচ্ছে। আওয়াজ যেভাবে কমে আসছে তাতে বুঝতে পারছি কৃষ্ণণ বাইকটাকে বেশ দূরে নিয়ে যাচ্ছেন স্পিড় তোলার সুবিধার জন্য।