এখানে বলে রাখি যে, অ্যাকটর হিসেবে তিনি যতই ভাল হন, লোক হিসেবে আমার জগু ওস্তাদকে তেমন ভাল লাগছে না। তার দুটো কারণ আছে। এক হল, জগু ওস্তাদের হাসিটা পরিষ্কার নয়। সত্যি বলতে কি, পান-দোক্তা খাওয়া অমন দাঁতে পরিষ্কার হতেও পারে না। দ্বিতীয় কারণ হল, দলের দুই চাকর ভিখু আর পঞ্চাননের সঙ্গে ভদ্রলোকের ব্যবহার মোটেই ভাল না। এটা আমার ভীষণ খারাপ লাগে, বিশেষ করে এই কারণে যে, ওরা দুজনেই দারুণ পরিশ্রম করতে পারে।
বিশুদা জগু ওস্তাদকে খুঁজতে যাবার আগে সুশীলবাবুর সঙ্গে কথা বলে গেল যে, ইতিমধ্যে যেন আমার শটটা নেওয়া হয়ে থাকে। আমি তো তৈরি, এখন শুধু বাকি আলো বসানো। সাধারণ বিজলিবাতিতে শুটিং সম্ভব নয়, তাই স্টুডিওর বড় আলো ব্যবহার করতে হবে। ডিরেক্টর সুশীলবাবু এসে আমাকে বুঝিয়ে দিলেন কেমন করে এ-ঘর থেকে ও-ঘর চলাফেরা করতে হবে। মনে মনে গুনগুন করে গান গাও, বললেন সুশীলবাবু, আর সেই গানের তালে তালে পা ফেলল। তা হলে চলাটা স্বাভাবিক আর মজাদার হবে। আসলে রাজপুত্রের কিছু করার নেই তাই সে আপনমনে এ-ঘর ও-ঘর করছে। এই ভাবটা ছবিতে ফুটে ওঠা চাই।
আমি একটু একটু গাইতে পারি, কিন্তু কী গান গাইব সেটা চট করে ভেবে পেলাম না। সুশীলবাবুকে জিজ্ঞেস করাতে উনি একটু ভেবে বললেন, ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায় জানো?
আমি হ্যাঁ বলতে সুশীলবাবু বললেন, ভেরি গুড, তা হলে ওটাই গুনগুন কোরো। আমি মনে মনে গানটা একবার গেয়ে নিলাম। পুরো গানের কথা মনে নেই, আর তার দরকারও নেই।
আধঘণ্টার মধ্যে শটটা খুব সুন্দরভাবেই হয়ে গেল। তারও আধঘণ্টা পরে বিশুদা এসে খবর দিল যে, জগু ওস্তাদকে পাওয়া গেছে। বিশুদা একেবারে ফায়ার হয়ে আছে দেখে আর বেশি কিছু জিজ্ঞেস করতে পারলাম না, কিন্তু কথাবার্তাতে বুঝলাম যে জগু ওস্তাদের নেশা করার বাতিক আছে; সে চলে গিয়েছিল রাজবাড়ি থেকে কিছু দূরে বাজারের মধ্যে একটা মদের দোকানে। সন্ধ্যা হলেই সে নাকি নেশা না করে পারে না।
এদিকে অন্য দুজন দস্যু তৈরি হয়ে বসে আছে, এবার জগু ওস্তাদকে মেক-আপ করে পোশাক পরে ছগনলাল সাজতে হবে। কাজেই আরও প্রায় এক ঘণ্টা লেগে গেল। বিশুদা এর মধ্যে একবার জিজ্ঞেস করে গেছে আমি বাড়ি যেতে চাই কিনা। আমার কিন্তু সব ব্যাপারটা ভীষণ ভাল লাগছে, তাই বলে দিলাম যে দস্যুদের শট না দেখে ফিরব না।
শট হতে হতে হয়ে গেল সাড়ে নটা। তিন গুণ্ডা রাজবাড়ির পাঁচিলের বাইরে একটা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে। পাঁচিলটা উঁচু হওয়াতে রাজবাড়ির শুধু চুড়োটা দেখা যাচ্ছে। তাই মগনলাল তরতরিয়ে গাছে উঠে যায়। আর তার দেখাদেখি অন্য দুজন গুণ্ডাও। এবার তারা অমৃৎকে দেখতে পায়। ঠিক এই সময় একজন টহলদার সেপাই এসে পড়ে। তার হাঁক শুনে তিন গুণ্ডা গাছ থেকে লাফিয়ে পড়ে দৌড়ে গিয়ে তাদের গাড়িতে উঠে পালায়।
শুটিং দেখে এটা বুঝতে পারলাম যে নেশাই করুক আর যাই করুক, জগু ওস্তাদ অ্যাকটিং-এ দারুণ পাকা। বিশুদা পরে বলেছিল, লোকটা মারাত্মক অভিনেতা। তাই ওর শত বদখেয়াল সত্ত্বেও ওকে না নিয়ে উপায় নেই। আমি মনে মনে বললাম, আর যাই করো বাবা, আমার সঙ্গে অ্যাকটিং করার সময়
নেশা করে এসো না। আমি শুনেছি মদের গন্ধ ভয়ানক খারাপ।
০৫. শুটিং থেকে রাত করে ফিরে
শুটিং থেকে রাত করে ফিরে বেশ ক্লান্ত লাগছিল, তাই খেয়ে নিয়েই শুতে চলে গেলাম। আগামীকাল অত ভোরে ওঠার দরকার নেই, কারণ সকালে শুধুই পুষ্করের মেলার ভিড়ের শট নেওয়া হবে, তাতে কোনও অভিনেতার দরকার হবে না। মেলা শুরু হবে কাল থেকেই, কাজেই খুব বেশি ভিড় হবার আগে কিছু শট নিয়ে রাখা দরকার। সন্ধেবেলা আবার কাজ আছে রাজবাড়িতে। এবারে হিরো শঙ্কর মল্লিককে লাগবে। দৃশ্যটা হচ্ছে–রাজা পুলিশে খবর দেবার পর ইনস্পেক্টর সূর্যকান্ত এসে অমৃৎকে জেরা করে। সব ব্যাপারটা জেনে নিচ্ছে। কাজেই আমারও কাজ আছে, আর পুলকেশ ব্যানার্জিরও আছে।
ওঠার তাড়া না থাকলেও সাতটার বেশি বিছানায় শুয়ে থাকতে পারলাম না। এক হিসেবে ভালই হল। কারণ বারান্দায় বেরিয়েই বিশুদার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। বিশুদা বলল, তুই আমাদের সঙ্গে আসবি?
আমি বললাম, কোথায়?
জায়গাটার নাম দৌরাল। এখান থেকে ষোলো কিলোমিটার দূর। গল্পের মতো একটা নালা পাওয়া গেছে, সেটা কৃষ্ণণকে দেখিয়ে দেব। ও একবার পরখ করে দেখতে চায় মোটর সাইকেলে টপকে পেরোনো যায় কিনা।
স্টান্টম্যান এসে গেছে?
আর বলিস না! বলল বিশুদা, ট্রেন প্রায় তিন ঘণ্টা লেট। কৃষ্ণণকে নিয়ে আমি ফিরেছি প্রায় রাত দেড়টায়।
তার মানে মোটর সাইকেলও থাকবে আমাদের সঙ্গে?
তা থাকবে বইকী! সেটা যাবে বাসের মাথায়। ওখানে গিয়ে চড়বে কৃষ্ণণ।
কৃষ্ণণ কোন দেশি লোক বিশুদা? ম্যাড্রাসি?
সেটা দেখলেই বুঝতে পারবি।
আটটার মধ্যে ব্রেকফাস্ট হয়ে গেল। আজ বাস ছাড়া কিছুই যাচ্ছে না, কারণ তিনটে গাড়িই পুষ্কর চলে গেছে শুটিং-এ। তবে আউটিং-এ অনেকেরই উৎসাহ। তাই যারা শুটিং-এ যায়নি তারা প্রায় সকলেই বাসে উঠে পড়ল। সবশেষে বিশুদার সঙ্গে এল একজন লোক যার বছর ত্রিশেক বয়স, গায়ের রঙ মোটামুটি পরিষ্কার, আর হাইট মাঝারির চেয়ে একটু বেশি। ভদ্রলোকের শরীর যে অত্যন্ত ফিট সেটা তার হাঁটাচলা দেখলেই বোঝা যায়।