আমি জানি যে গল্পে ইনস্পেক্টর সূর্যকান্তর সঙ্গে আমাকে মোটরবাইকের পিছনে চড়তে হবে, তাই ক্যারিয়ারে উঠে বসলাম, আর বিশুদা প্রচণ্ড শব্দ করে বাইক ছেড়ে দিল। আমার হাত দুটো বিশুদার কোমরে জড়ানো, কানের পাশ দিয়ে শনশন্ করে হাওয়া যাচ্ছে, এ এক দারুণ মজা। বিশুদা যে এত ভাল মোটরবাইক চালায় সেটা জানতামই না। সে মোটরগাড়ি চালায় অবিশ্যি অনেকদিন থেকেই।
তিন পাক ঘুরে বাইকটাকে আবার বাড়ির সামনে এনে দাঁড় করাল বিশুদা। এও একটা রিহার্সাল বইকী! আমার মন বলছে স্টান্টম্যান যদি তেমন ওস্তাদ হয়, তা হলে তার পিছনে চড়তে আমার কোনও ভয় লাগবে না। গল্পে এক জায়গায় আছে ইনস্পেক্টর সূর্যকান্ত মোহনকে ডাকাতদের হাত থেকে উদ্ধার করে মোটরসাইকেলে ছুটে চলেছে, আর ডাকাতরা তাদের তাড়া করেছে অ্যাম্বাসাডরে। তাদের এড়াবার জন্য সূর্যকান্ত রাস্তা ছেড়ে এবড়ো-খেবড়ো মাঠে নেমে পড়েছে। মোহন আঁকড়ে ধরে আছে। সূর্যকান্তর কোমর আর বাইক বেদম স্পিডে লাফাতে লাফাতে ছুটে চলেছে মাঠের উপর দিয়ে। আর তারপর? এটাই আসল, এখানেই হাততালি পড়বে সিনেমা হলে–মাঠ থেকে বাইক কাঁচা রাস্তায় নেমেছে, ডাকাতদের গাড়ি আবার তাদের পিছু নিয়েছে, এবার রাস্তা হঠাৎ চড়াই ওঠে। ওঠবার আগে মোটরসাইকেলের স্পিড ভীষণ বাড়িয়ে দেয় সূর্যকান্ত। তার কারণ আর কিছুই না–সামনে একটা দশ হাত চওড়া নালা, তাতে জল বইছে তেড়ে, সেই নালা এক লাফে পেরিয়ে উলটো দিকের উতরাইতে পড়তে হবে। গল্পে অবিশ্যি আছে সূর্যকান্ত স্বচ্ছন্দে নালা টপকে পেরিয়ে গেল, কিন্তু শুটিং-এ বম্বের স্টান্টম্যান সেটা পারবে কি? আর সেটা করার সময় কি আমাকেই থাকতে হবে মোটর সাইকেলের ক্যারিয়ারে স্টান্টম্যানের কোমর জড়িয়ে ধরে?
এ বিষয় এখন কিছু জিজ্ঞেস না করাই ভাল। যা হবার সে তো পরে জানতেই পারব। কাজটা ভাল হবার জন্য যদি আমাকেই থাকতে হয় তা হলে তাই করব।
সাইকেল থেকে নেমে বিশুদা বলল, সূর্যকান্তর জন্য এই বাইকটা ভাড়া করা হল। আশা করি ক্যাপ্টেনের পছন্দ হবে।
ক্যাপ্টেন? একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি। ক্যাপ্টেন আবার কে?
ক্যাপ্টেন কৃষ্ণণ, বলল বিশুদা, স্টান্টম্যান। আজ রাত্তিরে আসছে বম্বে থেকে।
কৃষ্ণণ! বম্বে থেকে এলেও লোকটা যে মাদ্রাজি সেটা নাম শুনেই বুঝতে পারলাম।
০৪. প্রথম দিনের কাজটা
প্রথম দিনের কাজটা খুব ভাল ভাবেই উতরে গেল। প্রথম শটই ছিল আমার–মোহনের পোশাকে এসে ঘরে ঢুকছি দেওয়ানের সঙ্গে। সামনে বাবা, পোশাক বদল দেখে প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা। প্রথমবারেই ঠিক হওয়ার জন এক চোট সকলের হাততালি পেলাম। এমনকী মিঃ লোহিয়া শুটিং দেখছিলেন তাঁর নাতিকে সঙ্গে নিয়ে, তিনিও হাততালিতে যোগ দিলেন। আজ বাবা-মার কথা মনে হয়ে মনটা একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এমন সুন্দর শুটিং তাঁরা দেখলে না জানি কত খুশি হতেন! কিন্তু পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আবার দ্বিতীয় শটের জন্য তৈরি হতে হবে বলে দুঃখটা ঝেড়ে ফেলে দিতে হল। বিশুদা প্রথম শট-এর সময় ছিল। সে শট-এর পর আমার পিঠে একটা চাপড় মেরে ফিসফিস করে বলে গেল, এইভাবে চালিয়ে যা। কুছ পরোয়া নেহি!
রাজার পার্টে পুলকেশ ব্যানার্জিও বেশ ভালই করলেন, কিন্তু তিনি একটা কথা বললেন লাঞ্চের সময়, সেটা আমার খুব মজার লাগল।–জানো মাস্টার অংশুমান, শিশু অভিনেতা পাশে থাকলে আর বড়দের দিকে কেউ চায় না। আমরা মিথ্যেই খেটে মরছি। এটাও লক্ষ করলাম যে প্রত্যেক শট-এর আগে পুলকেশবাবু চোখ বুজে বিড়বিড় করে কী যেন বলে নেন। বোধহয় ঠাকুরের নাম করে নেন।
মমতামাসির অ্যাকটিং-ও আমার খুব ভাল লাগল। বিশেষ করে চোখে জল আনার ব্যাপারটা। অনেক অ্যাক্টর নিজে থেকে চোখে জল আনতে পারে না। কান্নার দরকার হলে তারা শটের আগে চোখের কোনায় গ্লিসারিনের ফোঁটা দিয়ে নেয়। তার ফলে চোখ জ্বালা করে, আর সঙ্গে সঙ্গে চোখ জলে ভরে যায়। মমতামাসি বললেন তাঁর গ্লিসারিনের দরকার হবে না। অবাক হয়ে দেখলাম যে, সত্যিই তাই। দস্যুরা তাঁর ছেলেকে না নিয়ে ভুল করে অন্য ছেলেকে নিয়ে গেছে জেনে তাঁর এত আনন্দ হয়েছে যে, কান্নায় ভেঙে পড়ে নিজের ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
বিকেল পাঁচটার মধ্যে পুরো দৃশ্যটা শেষ হয়ে গেল। এর পরের কাজটা অন্ধকার হলে পর হবে; তার মানে সাতটার আগে নয়। পুলকেশবাবু আর মমতামাসি সার্কিট হাউসে ফিরে গেলেন। বাকি কাজটা খুবই সোজা; আমাকে শুধু এ ঘর ওঘর ঘুরতে হবে, আর ক্যামেরা সেটা পাঁচিলের বাইরে থেকে এমনভাবে তুলবে যে, মনে হয় যেন দস্যুরাই ব্যাপারটা দেখছে।
দুটো ঘণ্টা দিব্যি বেরিয়ে গেল গ্রামোফোন শুনে। মিঃ লোহিয়ার একটা চোঙাওয়ালা পুরনো গ্রামোফোন আছে, আর আছে রাজ্যির পুরনো হিন্দি ওস্তাদি গানের রেকর্ড। সেই সব রেকর্ড তিনি বাজিয়ে শোনাচ্ছিলেন। দম দেওয়া গ্রামোফোন এর আগে আমি কখনও দেখিনি। অ্যাসিস্ট্যান্ট মুকুল চৌধুরী খুব ওস্তাদি গানের ভক্ত; সে বলল, এসব রেকর্ড নাকি আজকাল একেবারেই পাওয়া যায় না। অথচ মিঃ লোহিয়া সেগুলোকে এমন যত্নে রেখেছেন যে, এতদিনেও পুরনো হয়নি।
সাতটার কিছু আগেই গান শোনা বন্ধ করে শটের জন্য তৈরি হতে শুরু করলাম। এবার রাজপুত্রের পোশাক, ঠিক পনেরো মিনিট লাগল তৈরি হতে। কিন্তু তা হলে কী হবে, খবর এল যে কাজে একটু দেরি হবে; আসল দস্য মগনলাল যে সাজবে সেই জগন্নাথ দে বা জগু ওস্তাদকে পাওয়া যাচ্ছে না। বিশুদা হন্তদন্ত হয়ে সকলকে জিজ্ঞেস করে বেড়াচ্ছে কেউ জগন্নাথকে দেখেছে কিনা। বিকেলে আমি নিজে দেখেছি ভদ্রলোককে; এর মধ্যে হঠাৎ তিনি গেলেন কোথায়?