খেতে খেতে সুশীলবাবু তুললেন মিঃ লোহিয়ার হিরে জহরতের কথা। আমরা নীলকান্তমণির মতো একটা আশ্চর্য জিনিস দেখে এসেছি বলে যারা যায়নি তারা সকলেই আফসোস করল।
দুপুরে খাবার পর আগামীকাল যে দৃশ্যটা শুটিং হবে সেটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। এটা জানি যে ছবির শুটিং ঠিক পর পর গল্পের ঘটনা ধরে হয় না। অনেক সময় পরের দিকের দৃশ্য আগে আর গোড়ার দিকের দৃশ্য শেষে তোলা হয়। যেমন, কালকে যে দৃশ্যটা প্রথম ভোলা হবে সেটা হল মেলা থেকে ফেরার পরের দৃশ্য। যদিও প্রথম দিনের কাজ, কিন্তু খুব সহজ নয়। আমি ফাইলটা খুলে কালকের পার্টটা একবার দেখে নিচ্ছি, এমন সময় বিশুদা এসে বলে গেল যে সন্ধেবেলা বারান্দায় রিহার্সাল হবে; আমি রাজা, রানি, রাজার দেওয়ান–সকলকেই থাকতে হবে। মনে মনে বললাম, এই শুরু হল কাজ।
এই কাজ করতে কত কী কাণ্ড হবে সেটা কি আগে থেকে জানতাম?
০৩. পরদিন ভোর ছটায় উঠতে হল
পরদিন ভোর ছটায় উঠতে হল। শুধু আমাকে নয়, যাদের শুটিং-এ দরকার হবে তাদের সকলকেই ভোর ছটায় চা এনে দিয়ে উঠিয়ে দিল পঞ্চানন বেয়ারা। ব্রেকফাস্ট পরে হবে–এটা ছিল যাকে বলে বেড-টি। আমার এ জিনিসে অভ্যাস নেই, কিন্তু এখানে আর সকলের সঙ্গে চা খেতে মোটেই খারাপ লাগল না। আজমীরে অক্টোবর মাসে সকালে একটা শীত শীত ভাব থাকে, তাই মমতামাসি আমাকে জোর করে একটা পুলোভার পরিয়ে দিলেন। রোদ বাড়লে সেটা খুলে ফেললেই হবে।
গতকাল রিহার্সাল ভালই হয়েছে। আমার যেটুকু ভয়-ভয় ভাব ছিল সেটা অন্যদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করে একদম কেটে গেছে। রাজবাড়িতে কিছু ছোট পার্ট করার জন্য আজমীর থেকেই তিনজন বাঙালিকে নেওয়া হয়েছে; তারা এখানের বহুদিনের বাসিন্দা। বিশুদাই খোঁজ করে তাদের জোগাড় করে এনেছে। বিশুদাকে সারাক্ষণ চরকিবাজির মতো ঘুরতে হয়। ওর কাজটাকে বলে প্রোডাকশন ম্যানেজারের কাজ। এই একজন লোক যার এক মুহূর্ত বিশ্রাম নেই।
আজ সকালে নটা থেকে কাজ আরম্ভ হবার কথা। একটার সময় লাঞ্চের জন্য একঘণ্টা ছুটি, তারপর আবার দুটো থেকে কাজ। আমার কাজটা বিকেলের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। সন্ধ্যার পরেও কাজ আছে, তাতে তিন গুণ্ডাকে দরকার হবে আর আমাকে লাগবে মাত্র একটা শটের জন্য। মগনলাল। গুণ্ডা তার দুই শাকরেদকে নিয়ে রাজবাড়ির পাঁচিলের বাইরে হানা দিতে এসেছে। তারা মতলব করছে। রাজকুমার অমৃৎকে নিয়ে পালাবে, তারই সুযোগ খুঁজছে। রাজবাড়ির বাইরে থেকে দোতলার একটা ঘরে তারা অমৃৎকে দেখতে পায়। অমৃৎ এ-ঘর সে-ঘর খেলা করে বেড়াচ্ছে, আর ছগনলাল তাকে মাঝে মাঝে দেখতে পাচ্ছে। এই হল দৃশ্য।
আজ আমাদের সব গাড়িগুলোকেই দরকার হল। বাসের মাথায় প্রথমে চাপানো হল ক্যামেরা চলার জন্য রেলগাড়ির মতো লাইন। টুকরো-টুকরো আট দশ ফুটের লাইন পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে বড় লাইন হয়ে যায়। তার উপর দিয়ে চলে চাকাওয়ালা গাড়ি, যাকে বলে ট্রলি, আর সেই ট্রলির উপর বসে ক্যামেরা। এই ট্রলিও উঠেছে বাসের মাথায়। আর উঠেছে স্টুডিওর বড় বড় আলো। দিনের বেলাও ঘরের ভিতর কাজ করতে বাইরে থেকে আসা আলোর সঙ্গে বাড়তি ইলেকট্রিক আলো যোগ করতে হয়।
আজ সকালে আমি ছাড়া অ্যাটিং–এর জন্য দরকার হবে রাজা, রানি, দেওয়ান আর আরও জনা তিনেক লোক, যাদের কোনও কথা বলতে হবে না। এদের বলা হয় একা, আর এদের সবাইকে আজমীরেই পাওয়া গেছে। এখানে একটা হিন্দি নাটকের দল আছে, তারা গতকাল সন্ধ্যায় এসেছিল সার্কিট হাউসে। তারা বলে গেছে তোক দিয়ে সাহায্য করবে।
সাড়ে সাতটার সময় আমাদের গাড়ি আর বাস রওনা দিয়ে দিল। মিঃ লোহিয়ার বাড়ি যেতে দশ মিনিট লাগে, কাজেই সময় আছে অনেক। কিন্তু তোড়জোড়ে যে অনেক সময় বেরিয়ে যায় সেটা আমি একদিন স্টুডিওতে টেস্ট দিয়েই বুঝেছি। যিনি রাজা সাজবেন, সেই পুলকেশ ব্যানার্জি প্রায় পনেরো বছর হল ফিল্মে অ্যাকটিং করছেন। সেইসঙ্গে থিয়েটারও করেন। তিনি গাড়িতে আমার পাশেই বসেছিলেন, যাবার পথে বললেন, এসো মাস্টার অংশুমান, আমাদের পার্টগুলো একটু ঝালিয়ে নেওয়া যাক। আমারও আপত্তি নেই, তাই গাড়ি চলতে চলতেই কয়েকটা রিহার্সাল দিয়ে দিলাম।
রাজবাড়িতে পৌঁছে আগে ব্রেকফাস্ট খেয়ে নেওয়া হল। মিঃ লোহিয়া পুরো একতলাটা ছেড়ে দিয়েছেন আমাদের জন্য। তা ছাড়া শুটিং-এর জন্য দোতলার তিনটে ঘর ছাড়া আছে। সেসব ঘরে চেয়ার টেবিল কার্পেট ছবি ঝাড়-লণ্ঠন সবই রয়েছে, আর সেগুলোই ছবিতে ব্যবহার করা হবে। ঘরে রাখার জন্য কলকাতা থেকে প্রায় কিছুই আনতে হয়নি।
যতক্ষণ একতলায় খাওয়া হচ্ছে, ততক্ষণে কাজের জিনিসপত্র দোতলায় যে ঘরে শুটিং হবে সেখানে চলে গেল। পুলকেশবাবু আর মমতামাসি খাওয়া শেষ করেই একতলার বারান্দায় মেক-আপ করার। জন্য বসে গেলেন। আমাকে রঙ মাখতে হবে না, শুধু চুলটাকে একটু অন্যরকমভাবে আঁচড়ে নিতে হবে। খানিকটা সময় আছে, তাই ভাবছি কী করব, এমন সময় একটা আওয়াজ শুনে আমার চোখ চলে গেল বাড়ির সামনের মাঠের দিকে। একটা মোটরসাইকেল মাঠের উপর ফটফটিয়ে বেড়াচ্ছে, আর তাতে চড়ে আছে বিশুদা।
দুপাক ঘুরেই বিশুদা সাইকেলটাকে আমার সামনেই এনে দাঁড় করিয়ে বলল, আয়, পেছনে বোস। দু চক্কর ঘুরিয়ে আনি তোকে।