গল্পটা জেনে আর পার্ট দুটো পড়ে আমার উৎসাহ দশগুণ বেড়ে গিয়েছিল, আর সেইসঙ্গে মনের মধ্যে নানান প্রশ্ন জমা হতে শুরু করেছিল। বিশেষ করে দুর্দান্ত সাহসী সূর্যকান্তর পার্টে কে অ্যাটিং করবে সেটা জানার জন্য ভীষণ কৌতূহল হচ্ছিল। বিশুদা বলল ওই পার্টে শঙ্কর মল্লিক বলে একজন নতুন ছেলেকে নেওয়া হচ্ছে, সে নাকি দারুণ স্মার্ট আর খুব ভাল দেখতে। আমি বললাম, কিন্তু ও কি মোটর সাইকেল চালাতে জানে?
বিশুদা হেসে বলল, তা জানে ঠিকই, কিন্তু স্টান্টবাজির জন্য তো মাইনে করা স্টান্টম্যান আসছে বম্বে থেকে।
স্টান্টম্যান? সে আবার কী?
সে পরে দেখতে পাবি, বলল বিশুদা।
পাঁচই অক্টোবর আমাদের শুটিং-এর দল রওনা দিল আজমীর। হাওড়া থেকে দিল্লি, দিল্লি থেকে বান্দিকুই, বান্দিকুই থেকে আজমীর। তার মানে দুবার চেঞ্জ। পাঁচই সন্ধ্যায় রওনা হয়ে সাতই রাত্রে পৌঁছানো। আগে থেকে বগি বুক করে রাখা ছিল। চাকরবাকর ছাড়া আর সকলেই ধরে। গেছে একটা ফার্স্ট ক্লাস বগিতে। ট্রেনেই আমার সকলের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল। অ্যাকটরদের মধ্যে এখন আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেন সাতজন। এদের কাজ একেবারে প্রথম দিকেই। বাকি সবাই ক্রমে ক্রমে এসে পড়বেন। অমৃৎ সিং-এর বাবা-মা, মানে রাজা-রানীর পার্ট করছেন পুলকেশ ব্যানার্জি আর মমতা সেন। ইনস্পেক্টর সূর্যকান্তের পার্ট করছেন শঙ্কর মল্লিক, সে তো আগেই বলেছি। এ ছাড়া আছেন গুণ্ডাদের সর্দার ছগনলালের পার্টে জগন্নাথ দে। ইনি বাংলা ছবির নামকরা দুষ্ট লোক, বা যাকে বলে ভিলেন। এঁকে সবাই জগু ওস্তাদ বলে ডাকে। এইসব অ্যাকটর ছাড়া আছেন ডিরেক্টর সুশীলবাবু, সাউন্ড রেকর্ডিস্ট উজ্জ্বল প্রামাণিক, ক্যামেরাম্যান ধীরেশ বোস, গল্পের লেখক সুকান্ত গুপ্ত, মেক-আপম্যান সজল সরকার। অ্যাসিস্ট্যান্টদের দলে আছেন সবসুদ্ধ আটজন, আর সবশেষে বিশুদা। এঁদের মধ্যে চোদ্দজন ট্রেন ছাড়বার কিছুক্ষণের মধ্যেই দুটো কামরায় ভাগ করে তাস খেলতে শুরু করেছেন। সাতজন খেলছেন রামি, আর সাতজন ফ্লাশ। আমি রামি জানি, তাই সেই কামরাতেই বেশিটা সময় কাটাচ্ছি। বিশুদাও রামির দলে ভিড়ে পড়েছে। যাঁরা খেলছেন না তাঁদের মধ্যে আছেন ডিরেক্টর সুশীলবাবু আর গল্প লিখিয়ে সুকান্ত। গুপ্ত। এঁরা দুজন ছবি নিয়ে আলোচনা করছেন। এছাড়া পুলকেশ ব্যানার্জি আর মমতা সেন দুজনেই হাতে ম্যাগাজিন নিয়ে বসে আছেন।
আমাকে আমার পার্ট দিয়ে দিয়েছে বিশুদা কলকাতায় থাকতেই। একটা ফাইলের মধ্যে প্রায় বিশপাতা ফুলস্ক্যাপ কাগজ। সেটা বাবা একবার পড়িয়ে শুনিয়ে দিয়েছেন আমাকে। তা থেকে আমি খানিকটা বুঝে গেছি কীভাবে আমাকে অ্যাটিং করতে হবে। খুব বেশি কথা নেই, তাই মুখস্থ করতে অসুবিধা হবে না। আসবার দুদিন আগে কলকাতার স্টুডিওতে আমার টেস্টটা নেওয়া হয়ে গেছে; তাতে শঙ্কর মল্লিকের সঙ্গে একটা ছোট দৃশ্যে আমাকে রাজস্থানি পোশাক পরে অ্যাটিং করতে হয়েছে ক্যামেরার সামনে। কাজটা নিশ্চয়ই ভাল হয়েছিল, তা না হলে সুশীলবাবু কেন আমার পিঠ চাপড়ে দুবার একসেলেন্ট বলবেন? আর সেই থেকেই লক্ষ করছি আমার সঙ্গে চোখাচোখি হলেই সুশীলবাবু হাসছেন।
বর্ধমানে থালিতে ডিনার খাবার পর আমি একটা আপার বার্থে উঠে নিজেই হোন্ডঅল খুলে বিছানা পেতে শুয়ে পড়লাম। মমতা সেন আমার কামরায় ছিলেন। তিনি বললেন, তুমি আমাকে এবার থেকে মমতামাসি বলে ডাকবে, কেমন? আর কোনও কিছু দরকার-টরকার হলে আমাকে বলবে।
আমি পাশ ফিরে চোখ বুজে ভাবতে লাগলাম। না জানি কত কী ঘটনা ঘটবে সামনের একমাসে। বিশুদা আছে, তাই বাবা-মা যে নেই সেকথা মনেই হচ্ছে না। একবার কালিম্পং গিয়েছিলাম আমার মামাতো ভাই-বোনদের সঙ্গে। সেবারও বাবা-মা ছিলেন না। আমার কিন্তু কোনও অসুবিধাই হয়নি।
আমি জানি এবারও হবে না। কাজের মধ্যে দেখতে দেখতে একমাস পেরিয়ে যাবে।
এই ভাবতে ভাবতেই কখন যে ঘুম এসে গেছে, টেরই পাইনি।
০২. বাবা কলেজে ইতিহাস পড়ান
বাবা কলেজে ইতিহাস পড়ান, তিনিই আমাকে বলেছিলেন যে, আজমীর শহরটা ঘোড়শ শতাব্দীতে আকবর দখল করে নেন মারওয়াড় অধিপতি মালদেও-এর হাত থেকে। উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে আজমীর ব্রিটিশদের হাতে চলে আসে। আজমীর থেকে এগারো কিলোমিটার পশ্চিমে হল পুষ্কর। এটা হল হিন্দুদের একটা বড় তীর্থস্থান। এখানে একটা হ্রদ আছে যেটাকে ঘিরে প্রতি বছর কার্তিক মাসে একটা মেলা বসে, যাতে লাখের উপর লোক আসে। আমাদের ফিল্মের গল্পে অবিশ্যি আজমীর হয়ে যাচ্ছে কাল্পনিক শহর হিণ্ডোলগড়। আমাদের ফিল্মের নামও হিণ্ডোলগড়। পুষ্কর অবিশ্যি পুষ্করই থাকছে, আর এই পুষ্করের মেলাতেই ইস্কুল মাস্টারের ছেলে মোহনের সঙ্গে রাজকুমার অমৃৎ সিং-এর আলাপ হচ্ছে।
রাত করে আজমীর পৌঁছে আমরা সোজা চলে গেলাম সার্কিট হাউসে। এইখানেই নি সপ্তাহের জন্য আমরা থাকব। বেশ বড় সার্কিট হাউস, দোতলায় উত্তর আর পশ্চিমে চওড়া বারান্দা, সেখানে দাঁড়ালেই উত্তরে প্রকাণ্ড আনা সাগর লেক, আর পশ্চিমে পাহাড় দেখা যায়। রাত্তিরে অবিশ্যি দেখার কিছুই নেই, কিন্তু বেশ বুঝতে পারছিলাম যে আমরা একটা অদ্ভুত জায়গায় অদ্ভুত বাড়িতে এসে পড়েছি। আকাশে তিনভাগের একভাগ চাঁদের ফিকে আলো পাতলা কুয়াশায় ঢাকা লেকের জলে পড়ে দারুণ দেখাচ্ছে। দূরে শহরে কোথায় যেন ঢোলক বাজিয়ে গান হচ্ছে, এ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই।