তিন মিনিটের মধ্যে ইনস্পেক্টর মাহেশ্বরীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আমাকে দেখেই ভদ্রলোক চিনলেন। কেষ্টদার গায়ে ইনস্পেক্টরের পোশাক দেখে ভদ্রলোক হেসেই ফেললেন।
কী চাই আপনাদের?
লোহিয়াজির পাথর, বলল কেষ্টদা, আমি জানি কোথায় আছে। একটা জিপে চলে আসুন আমার সঙ্গে। যদি দেখেন ভুল বলছি তা হলে আমাকে হাজতে পুরবেন।
হয়তো কেষ্টদার কথা বলার ভঙ্গির জন্যই মাহেশ্বরী রাজি হয়ে গেলেন।
ঠিক হ্যায়, আমি আসছি আপনার সঙ্গে।
সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে নেবেন।
ও. কে.।
বাইকে উঠেই কেষ্টদার কব্জিটা ধরে ঘুরিয়ে একবার ঘড়িটা দেখে নিলাম। ছটা বাজতে দশ। জগু ওস্তাদ স্টেশনে রওনা হয়ে গেছে নিশ্চয়ই।
বাইরে অন্ধকার। শহরের বাতি জ্বলে গেছে।
রাস্তার ট্র্যাফিককে আশ্চর্যভাবে বাঁচিয়ে কেষ্টদা বিদ্যুদ্বেগে ছুটে চলেছে স্টেশনের উদ্দেশে। পিছনে পুলিশের জিপ। বাইকের সঙ্গে তাল রেখে সেও চলেছে ছুটে। ঘন ঘন হর্ন দিয়ে তোক সরানো হচ্ছে রাস্তার মাঝখান থেকে।
স্টেশন এসে গেছে। কটা বাজল? থানা ছাড়বার পর পাঁচ মিনিটও হয়নি।
স্টেশনের বাইরে বাইক আর জিপ পর পর থামল।
ওই যে জগু ওস্তাদ! আমি চেঁচিয়ে উঠলাম।
ঠিক কথা। সেও সবেমাত্র স্টেশনে পৌঁছেছে। কুলির মাথায় মাল চাপাচ্ছে অটো-রিকশা থেকে নেমে।
দ্যাট ইজ দ্য ম্যান! জগু ওস্তাদের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে মাহেশ্বরীকে বলল কেষ্টদা।
মাহেশ্বরী জগু ওস্তাদের দিকে এগিয়ে গেলেন, তাঁর হাতে রিভলভার।
জগন্নাথ দে ওরফে জগু ওস্তাদ শেষ মুহূর্তে পালাবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পারেনি। দুদিক থেকে দুই পুলিশ এসে তাকে ধরে ফেলেছিল। তার কাছেই যে মিঃ লোহিয়ার নীলকান্তমণিটা পাওয়া গেল সেটা বোধ হয় আর না বললেও চলবে। পাথর ফেরত পেয়ে মিঃ লোহিয়া এত খুশি হলেন যে, কেষ্টদাকে দু হাজার টাকা পুরস্কার দিয়ে ফেললেন। এটা যে হবে সেটা আমি জানতাম। কেষ্টদা স্টান্টম্যান ঠিকই, কিন্তু এটাও ঠিক যে এই পাথর উদ্ধার করার মতো স্টান্ট সে কোনওদিন করেনি।
সবচেয়ে আফসোস হয়েছিল বিশুদার। আপনাকে সেদিন ভুল করে কত কথা বলে ফেলেছিলাম; আশা করি আপনি অপরাধ নেবেন না।
অপরাধ আমি নিশ্চয়ই নেব না, বলল কেষ্টদা, কারণ এ ছবিতে কাজ করে, বিশেষ করে মাস্টার অংশুর সঙ্গে কাজ করে, আমি সত্যিই খুব খুশি হয়েছি।
আমি একটা কথা বলতে চাই আপনাকে, বলল বিশুদা।
কী, বলুন!
আপনাদের তো টাইটেলে কখনও নাম যায় না–আমি কথা দিচ্ছি এবার আমাদের ছবিতে আপনার নাম বড় করে আলাদা করে যাবে।
তা হলে আমার অনেকদিনের একটা সাধ পূর্ণ হবে, বলল কেষ্টদা।
এসব কথা হচ্ছিল স্টেশনে। আমরা কাল সকালে সামান্য কয়েকটা কাজ সেরে সন্ধ্যার ট্রেনে রওনা দেব; আজ কেষ্টদা বম্বে চলে যাচ্ছে, আমরা তাকে বিদায় দিতে এসেছি। কেষ্টদা এবার আমার দিকে ফিরল। তারপর তার ডান হাতটা বাড়িয়ে আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বলল, আমি তো দশ বছর হল স্টান্ট করছি, কাজটা আমার কাছে নাওয়া-খাওয়ার মতোই সহজ হয়ে গেছে; কিন্তু তুমি বারো বছর বয়সে তোমার প্রথম ছবিতেই যে সাহস দেখালে, সে স্টান্টের কোনও জবাব নেই।
কিন্তু আবার কবে দেখা হবে কেষ্টদা?
যেদিন এই ছবি রিলিজ করবে সেইদিন। মিঃ লোহিয়ার দেওয়া টাকা দিয়ে আমি নিজে টিকিট কেটে চলে আসব। নইলে বাংলা ছবি তো আর এমনিতে বোম্বাই পৌঁছবে না।
ট্রেনে হুইসল দিয়ে দিয়েছিল। একটা ছোট্ট লাফ দিয়ে কেষ্টদা পাদানিতে উঠে পড়ল।
আসি, মাস্টার অংশু। ঠিকানাটা রেখে দিয়েছ তো?
হ্যাঁ হ্যাঁ।
চিঠি লিখো।
ট্রেন ছেড়ে দিল।
নিশ্চয়ই লিখব কেষ্টদা। নিশ্চয়ই লিখব।
যতক্ষণ দেখা গেল কেষ্টদাকে ততক্ষণ সে পাদানিতে দাঁড়িয়ে এক হাত দিয়ে রড ধরে ঝুলে বাইরে বেরিয়ে অন্য হাত নাড়িয়ে আমাকে বিদায় জানাল।
দেশ শারদীয়, ১৩৯২ ৪৮২