কেষ্টদা আমার কথার কোনও উত্তর দিল না। আমি ওর পিঠে হাত রাখলাম ওকে সান্ত্বনা দেবার জন্য। বিশুদা ওর সঙ্গে এমনভাবে কথা বলে সত্যিই অন্যায় করেছে।
এবার কেষ্টদা কথা বলল, তার গলা ভারী আর গম্ভীর।
আমাকে কিছু বলতে এসো না। আমি বুঝেছি মানুষের উপকার করতে যাওয়া হচ্ছে বোকামো। বম্বে হলে লোকে আমার কথা মানত।
আমার ভয় হল যে কেষ্টদা হয়তো রেগে গিয়ে আর শটটাই দেবে না। আমি তাই বাধ্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেষ্টদা, তুমি বাকি কাজটা করবে তো?
দেখা যাক, বলে কেষ্টদা চুপ করে গেল।
বৃষ্টি এল না, কিন্তু মেঘ জমে রইল। হাওয়াও বন্ধ হয়ে গেছে, তাই মেঘ আর সরতেই চায় না। আমার চোখ বারবার আকাশের দিকে চলে যাচ্ছে। শুধু আমি কেন, দলের সকলেই ওই একটা শট-এর অপেক্ষায় খালি খালি উপর দিকে চাইছে। সূর্যটা যে কোথায় আছে সেটা অবিশ্যি বোঝা যায়; এমনকী এক-একসময় মেঘ পাতলা হয়ে চারিদিকের আলো বেড়ে ওঠে, কিন্তু রোদ ওঠার নাম নেই। ক্যামেরাম্যানরা তাদের কাজের জন্য একটা কালো কাঁচ ব্যবহার করে, সেটা একটা ফিতে দিয়ে গলায় ঝোলানো থাকে। ধীরেশ বোস বারবার সেই কাঁচের ভিতর দিয়ে আকাশের দিকে দেখছেন।
সাড়ে চারটে।
হঠাৎ দেখি কেষ্টদা বাইকটা নিয়ে হাতে করে ধরেই সেটা নালার ওপারে করে নিল, কারণ শটে ওদিক থেকেই আসবে বাইকটা। আমি মনে খানিকটা ভরসা পেলাম। মনে হচ্ছে কেষ্টদার রাগ কিছুটা পড়েছে। রাগ করবার যে যথেষ্ট কারণ ছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। অ্যাক্সিডেন্টের পর থেকেই জানি যে শয়তানির গোড়ায় রয়েছেন জগু ওস্তাদ। নীলকান্তমণি চুরি করে বিক্রম জগু ওস্তাদকেই দিয়েছে। কেষ্টদা যে ফন্দিটা ধরে ফেলেছে সেটা জগু ওস্তাদ কোনওরকমে জেনে ফেলেছে, আর তাই বদলা নেবার জন্য গতকাল তোকজন নিয়ে এসে রাস্তাটা খুঁড়ে আলগা মাটি দিয়ে ভরিয়ে রেখে গেছে। অথচ বিশুদা কেষ্টদার কথাটা বিশ্বাস করল না। শুধু বিশুদা কেন, কেউই করল না। স্টান্টম্যান বলে কি তার কথাও বিশ্বাস করতে নেই?
ইতিমধ্যে আমি অমৃতের পোশাক পরে নিয়েছি, আর দেখে নিশ্চিন্ত হলাম যে কেষ্টদাও গোঁফ লাগিয়েই ইনস্পেক্টরের পোশাক পরে নিল। কেষ্টদা রেডি হবার সঙ্গে সঙ্গেই দলের চার-পাঁচজন একসঙ্গে বলে উঠল–রোদ বেরিয়েছে!
আকাশের দিকে চেয়ে দেখি, সত্যিই মেঘ কেটে গিয়ে সূর্যসমেত অনেকখানি নীল আকাশ বেরিয়ে গেছে। অন্তত পাঁচ মিনিট থাকবে নিশ্চয়ই।
ক্যামেরাজ রেডি?
এই হুঙ্কারটা ছাড়লেন স্বয়ং ডিরেক্টর সুশীল মিত্তির।
তিনটে ক্যামেরা তিন জায়গায় রাস্তার–দুপাশে আর নালার ধারে–বসিয়ে রাখা হয়েছে অনেক আগে থেকেই। এবারে তিনজন ক্যামেরাম্যান রেডি হয়ে গেলেন।
চলো মাস্টার অংশু! গম্ভীরভাবে বলল কেষ্টদা।
আমি আর কেষ্টদা মোটরবাইকে উঠে পড়লাম। ক্যামেরা স্টার্ট দিলে চেঁচিয়ে বোলো, হাঁক দিলেন সুশীলবাবু, তারপর বাইক স্টার্ট হবে।
এবারে কেষ্টদা বাইকটাকে আরও বেশ অনেকখানি দূরে নিয়ে গেল। আগেরবার কিন্তু এতদুর থেকে রওনা হয়নি। এবার কি তা হলে আরও স্পিডে বাইক আসবে? আমার সেটা কেষ্টদাকে জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু এখন আর ওসবের সময় নেই।
সবাই রেডি? সুশীলবাবু চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন। তিন ক্যামেরাম্যান আর কেষ্টদা বলে উঠল–রেডি!
আমি ক্যারিয়ারে বসে আমার হাত দুটো কেষ্টদার কোমরের দুদিক দিয়ে পেঁচিয়ে দিয়েছি।
আজ স্পিড বাড়াব, দাঁতে দাঁত চেপে নিজেই বলল কেষ্টদা, শক্ত করে ধরে থাকবে। কোনও ভয় নেই।
স্টার্ট ক্যামেরা!
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিন ক্যামেরাম্যান একসঙ্গে বলে উঠল–রানিং!
আর চার-পাঁচ সেকেন্ড পরেই শোনা গেল।
স্টার্ট বাইক!
গোঁ করে গর্জন করে একটা ধাক্কা দিয়ে বাইক ছুটতে শুরু করল। আজ আর আমি চোখ বুজলাম। আজ চেয়ে থাকব, সব দেখব। আগের দিনের দেড়া স্পিডে তীরবেগে চড়াই দিয়ে উঠে গেল বাইক।
এবারে সমস্ত পৃথিবীটা হঠাৎ যেন নীচে নেমে গেল।
বাইক শূন্যে উঠেছে। প্রচণ্ড হাওয়া।
শুন্য দিয়ে এগিয়ে আবার নীচের দিকে নামতে শুরু করেছে।
পৃথিবী আবার উপরে উঠে এল।
এবার বুঝলাম স্পিড বাড়ানোর কারণ। গর্তটা ছাড়িয়ে শক্ত জমিতে নামবে কেষ্টদা। আমাকে পিছনে নিয়ে কোনও রিস্কের মধ্যে সে যাবে না।
একটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনির সঙ্গে বাইক আবার মাটিতে এসে নামল। আমি শুনলাম বহুদূর থেকে চিৎকার ভেসে এল—
ও. কে.!
আর তারপরে আরও দুটো ও. কে.!
তার মানে তিনটে ক্যামেরাতেই শট ঠিকভাবে উঠেছে।
কিন্তু বাইক থামছে না কেন?
কেষ্টদা কোথায় চলেছে?
প্রশ্নটা মনের মধ্যে আসতেই আমি উত্তরটা পেয়ে গেলাম।
বিশুদা যাই বলুক, কেষ্টদা তার নিজের বিশ্বাসে কাজ করে চলেছে।
নালার জায়গাটা সার্কিট হাউস থেকে চোদ্দ কিলোমিটার। প্রচণ্ড স্পিডে দশ মিনিটে আজমীরে পৌঁছে একটা চৌমাথায় আসতেই একটা ট্রাফিক পুলিশের ঠিক পাশে এসে বাইকটা থামাল কেষ্টদা। তারপর পুলিশটিকে জিজ্ঞেস করল থানাটা কোথায়।
পুলিশ বুঝিয়ে দিতেই বাইক ছুটল আবার ঊর্ধ্বশ্বাসে। কত স্পিডে যাচ্ছে বাইক? আশি? নব্বই? আমি জানি না। শুধু জানি এত স্পিডে আমি কোনওদিন কোনও গাড়ি চড়িনি। হাওয়ার শব্দে কান প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে, গায়ের লোম খাড়া।
এই যে পুলিশ স্টেশন।