আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে দরকার হবে?
কেষ্টদা মাথা নাড়ল–তুমি চড়বে একেবারে শট-এর সময়।
পথের ডান পাশে কিছু দূরে একটা তেঁতুল গাছ, তারই নীচে দলের সকলে খেতে বসেছে। কেষ্টদা চেঁচিয়ে জানিয়ে দিল যে, সে একটা রিহার্সাল করে নিচ্ছে। আজই ওর শেষ কাজ, সেটা হলেই ও বম্বে ফিরে যাবে, হয়তো আর কোনওদিনও দেখা হবে না। এটা মনে হলেই আমার খুব খারাপ লাগছিল।
কেষ্টদা বাইকটাকে দাঁড় করিয়েছে নালা ঘেঁষে বেশ কিছুটা দূরে রাস্তার উপর।
নালার দিকে কেউ নেই তো? হাঁক দিয়ে জিজ্ঞেস করল কেষ্টদা।
বিশুদা পরিবেশন করছিল, চেঁচিয়ে বলল, না, সবাই এখানে।
আমি রিহার্সালটা দেখব বলে দৌড়ে নালার ধারে চলে গেলাম। তারপর গলা ছেড়ে হাঁক দিলাম, এসো, কেষ্টদা!
আবার সেই কানফাটা শব্দ, সেই আচমকা ঝোঁপের পিছন থেকে বেরোনো, সেই দমবন্ধ করা লাফ, আর সেই ম্যাজিকের মতো–
কিন্তু এ কী? ওপারে গিয়ে বাইকটা একী হল? সেটা যে মুখ থুবড়ে পড়েছে উতরাইটা পেরিয়েই, আর কেষ্টদা যে বাইক থেকে ছিটকে গিয়ে পড়েছে ঝোঁপের মধ্যে।
বিশুদা!
চিৎকার ছেড়ে জুতো মোজা পরেই নালা পেরিয়ে উলটো দিকে গিয়ে উঠলাম।
মোটরবাইকটা একপাশে কাত হয়ে পড়ে আছে, তার একটা চাকা এখনও বনবন করে ঘুরছে, আর কেষ্টদা রাস্তা থেকে উঠে গা থেকে ধুলো ঝাড়ছে।
আমি স্টান্টম্যান বলেই আজ বেঁচে গেলাম, অংশুবাবু! অন্য কেউ হলে…
ব্যথা পেয়েছ নিশ্চয়ই?
আমার বুকের ভেতরে ঢিপঢিপ করছিল।
ঝোঁপটা বাঁচিয়ে দিয়েছে। নইলে মাথায় চোট পেতাম নির্ঘাত।
কিন্তু কী করে–?
ব্যাপারটা আর কিছুই না; রাস্তাটাকে খুঁড়ে গর্ত করে তারপর আলগা মাটি দিয়ে বুজিয়ে কিছু পাথর আর খোলামকুচি ওপরে ছড়িয়ে দিয়েছিল। দেখেই বুঝতে পারছ নিশ্চয়ই। তাই বাইকটা এসে পড়তেই মাটির ভিতর ঢুকে গেছে।
বিশুদার সঙ্গে প্রায় সকলেই আমার ডাকে ছুটে এসেছে। কাণ্ড দেখে সকলের চক্ষুস্থির।
কিন্তু এরকম করল কে? প্রশ্ন করলেন সুশীলবাবু, আপনার উপর কারুর আক্রোশ আছে নাকি যে আপনাকে এভাবে টাইট দেবে?
কেষ্টদার ঘাড় আর গাল ছড়ে গিয়েছিল; আমাদের সঙ্গে ফাস্ট এড বক্স ছিল, তার থেকে ওষুধ নিয়ে লাগিয়ে দেওয়া হল।
সুশীলবাবু আবার জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কোনও ধারণা আছে এ-কাজ কে করে থাকতে পারে?
কেষ্টদা বলল, তা আছে, তবে কেন সে ধারণা হয়েছে সেটা বললে অনেক কিছু বলতে হয়। আমি শুধু বলছি যে আপনাদের জগু ওস্তাদ বলে যে অভিনেতাটি আছেন, তাঁর কলকাতা যাওয়া আপনারা বন্ধ করুন।
বিশুদা দেখলাম কথাটা ভালভাবে নিল না। বলল, আপনি শুধু ওরকম বললে তো চলবে না। কেন এমন একটা ব্যাপার করতে বলছেন সেটা আমাদের জানতে হবে। আপনি কারণটা বলুন। কথা নেই। বার্তা নেই আমাদের দলের একজনের ঘাড়ে দোষ চাপালে তো চলবে না। আপনার কি তার সঙ্গে কোনওরকম ঠোকাঠুকি লেগেছিল?
কেষ্টদাকে অগত্যা সব কথাই বলতে হল। আমি এখন জানি যে, কেষ্টদার কথাই ঠিক, কিন্তু বিশুদা তার কথায় আমলই দিল না।
দেখুন, কাপ্তেন মশাই, বলল বিশুদা, জগু ওস্তাদ যে সন্ধেবেলা নেশা করে সেটা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু তার নামে চুরির অপবাদ কেউ কোনওদিন দেয়নি। অনেকদিন হল সে ফিল্মের লাইনে কাজ করছে, আর কাজটা সে ভালভাবেই করে এটা কেউ অস্বীকার করবে না। আপনি বোম্বাই থেকে এসে বাংলার একজন অভিনেতা সম্পর্কে এমন একটা গুরুতর অভিযোগ করবেন সেটা তো আমরা বরদাস্ত করতে পারব না। আপনি মদের দোকানে তার মুখ থেকে কী কথা শুনেছেন সেটা তো আমি মানতে রাজি নই। আপনি নিজে যে নেশা করেন না তার কী প্রমাণ?
কেষ্টদা বলল, আমি এককালে মাঝে মাঝে নেশা করতুম সেটা অস্বীকার করব না, কিন্তু একবার একটা স্টান্টে গড়বড় হয়ে যাবার পর থেকে গত পাঁচ বছরে আমি মদ ছুঁইনি। আমি যা শুনেছি তা ঠিকই শুনেছি, তাতে কোনও ভুল নেই। আজকের ঘটনাটাই প্রমাণ করছে যে আমি ভুল শুনিনি। সেটা আপনারা বিশ্বাস করেন কি না করেন সেটা আপনাদের ব্যাপার। আজকের এই অ্যাক্সিডেন্টের পর আমি একবারে শিওর যে জগু ওস্তাদের কাছেই রয়েছে ওই পাথর, আর আমি তার কথা শুনে ফেলেছিলাম বলেই সে রাস্তা খুঁড়ে রেখে আমাকে খতম করার চেষ্টা করেছিল।
সুশীলবাবুকে ভীষণ চিন্তিত বলে মনে হচ্ছিল; এবার উনিই কথা বললেন—
যাই হোক, এখন আসল কথা হচ্ছে যে, এই রাস্তা দিয়ে আর বাইক চালানো যাবে কি না। শটটা তো আমাদের নিতে হবে। আর এখানেই নিতে হবে, কারণ আমরা জানি যে এ ছাড়া আর কোনও রাস্তা এইভাবে এই নালার উপর এসে পড়েনি।
শট নিতে কোনও বাধা নেই, বলল কেষ্টদা, ওই গর্তটাকে শক্ত মাটি আর পাথর দিয়ে ভাল করে বুজিয়ে দিলেই শট নেওয়া যাবে। ওটা প্রায় ফাঁপা ছিল বলে বাইক ওর মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল।
আধঘণ্টার মধ্যে সবাই মিলে কাজ করে গর্তটাকে আবার বুজিয়ে দেওয়া হল। ঘড়িতে বলছে আড়াইটা। তা হলে এখন কি শট নেওয়া যায়?
না, যায় না, কারণ আকাশ মেঘে ভরে গেছে। চারিদিক অন্ধকার হয়ে এসেছে। এমন কী বৃষ্টি নামলেও কিছু আশ্চর্য হবার নেই।
আমি জানি যে রোদ না উঠলে শট নেওয়া যাবে না। আমি কেষ্টদাকে একা পেয়ে তার পাশে গিয়ে ফিসফিস করে বললাম, জগু ওস্তাদ কিন্তু পৌনে ছটায় সার্কিট হাউস থেকে বেরোবে। সাড়ে ছটায় ওর ট্রেন।