তাই করলেই তো পারতেন, বলল কেষ্টদা, তা হলে আর এই কেলেঙ্কারিটা হত না।
পাথর তো আর ওই ব্যাটার কাছে নেই, বলল জগু ওস্তাদ, ওটা অন্য জায়গায় পাচার করে মোটা বকশিশ নিয়ে ভেগেছে ব্যাটা বিক্রম। পুলিশের বুদ্ধি থাকলে এখানকার যত হিরে জহরতের কারবারি আছে তাদের বাড়ি রেড করা উচিত। জলের দরে অমন একটা পাথর পেলে এরা তো লুফে নেবে। যে পাথরের দাম হয়তো বিশ লাখ, তার জন্য হাজার দু হাজার পেলেও ওই বিক্রম ব্যাটা বর্তে যাবে। একটা সামান্য চাকরের আর চাহিদা কত হতে পারে?
জগু ওস্তাদ তার কথা শেষ করে গুড নাইট করে চলে গেল। আমি একটু অবাক হয়ে কেষ্টদার দিকে চাইলাম।
কী মনে হচ্ছে কেষ্টদা? কেষ্টদা চুপ মেরে গেছে। দুবার এপাশ ওপাশ মাথা নাড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, সব গুলিয়ে যাচ্ছে। এখন এক-একবার সত্যিই মনে হচ্ছে আমি ভুল শুনেছিলাম। অবিশ্যি সেটা হলেই ভাল হয়। যদি প্রমাণ হয় যে ওস্তাদ পাথরটা নিয়েছে বিক্রমের কাছ থেকে তা হলে ফিল্ম অ্যাকটরদের বদনাম হবে। সেটা মোটেই ভাল নয়।
না, তা নিশ্চয়ই নয়।
১০. অ্যাকটিং-এর সময়
এই ঘটনার পরে অ্যাকটিং-এর সময় আমার বেশ কয়েকবার কথা গুলিয়ে গিয়ে এন. জি হল। এন. জি. মানে নো গুড। তার মানে শটটা আবার নিতে হবে। শট যদি ঠিক থাকে তা হলে সেটা হয় ও. কে.। একটা শট শেষ হওয়া মাত্র ডিরেক্টর বলে দেন সেটা ও. কে. না এন. জি.। সুশীলবাবু আমাকে একবার জিজ্ঞেস করলেন, অংশু, তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?কথাটা খুব নরম করে বললেও আমার ভীষণ লজ্জা লাগছিল। কারণ আর কিছুই না; নীলকান্তমণির ব্যাপারটা কিছুতেই ভুলতে পারছিলাম না বলেই যত গণ্ডগোল। বিশেষ করে জগু ওস্তাদের কথাগুলো বারবার মনে হচ্ছিল, আর মন বলছিল জগু ওস্তাদ নির্দোষ। ও যা বলেছে সেটাই আসলে ঠিক, কেষ্টদা নিশ্চয়ই উলটোপালটা শুনেছে।
দুদিন লাগল মন থেকে নীলকান্তমণির চিন্তাটা তাড়িয়ে দিয়ে অ্যাকটিং করতে। তারপর অবিশ্যি আর এন. জি. হয়নি।
ইনস্পেক্টর মাহেশ্বরী কিন্তু তদন্তের ব্যাপারে বেশ নাজেহাল হচ্ছেন। সে-চাকর শহর ছেড়ে পালিয়েছে বটেই, কিন্তু সে যে কোথায় গা-ঢাকা দিয়েছে সেটা পুলিশ অনেক চেষ্টা করেও বার করতে পারছেন না।
তেইশ তারিখ সকালে আমার শুটিং ছিল মোহনের বাড়িতে। ইনস্পেক্টর সূর্যকান্ত গুণ্ডাদের হাত থেকে মোহনকে উদ্ধার করে তার বাবার কাছে এনে দিচ্ছে, বাবা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরছে।
এই শুটিং মিঃ মাহেশ্বরী তাঁর স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে দেখতে এলেন। বিশুদার প্রশ্নের উত্তরে উনি বললেন যে চোর এখনও ধরা পড়েনি। তবে বিক্রম যে লোক সুবিধের ছিল না তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। বাজারে যাবার নাম করে মদের দোকানে গিয়ে মদ খেত। যেদিন চুরিটা হয় সেদিনও সে মদের দোকানে গিয়েছিল।
পরদিন–চব্বিশ তারিখ–ভীষণ জরুরি দিন। আজকে মোটরবাইকে চড়ে কেষ্টদা আমাকে নিয়ে নালা টপকাবে। এই দৃশ্য তোলার জন্য দুটো বাড়তি ক্যামেরা লোকসমেত বম্বে থেকে এসেছে। সার্কিট হাউসে ঘর খালি করা হয়েছে, তাই তারা সেখানেই এসে উঠেছে, বাইকে নালা পেরনোর ব্যাপারটা একবারের বেশি করা রিস্কি বলে দৃশ্যটা তিনটে ক্যামেরা দিয়ে তিন জায়গা থেকে একই সঙ্গে ভোলা হবে। একটা চড়াই দিয়ে এগোনোর সময়, একটা নালা টপকে পেরোনোর সময়, আর একটা উলটোদিকে উৎরাইয়ের মুখে ল্যান্ড করার সময়।
অবিশ্যি এই সিনের আগে সকালে অন্য কাজ আছে। তাতে তিন গুণ্ডা আর পুলিশের দল লাগবে। পুলিশ ছগনলালের দলকে গ্রেপ্তার করার দৃশ্য। ইনস্পেক্টর মাহেশ্বরী স্থানীয় পুলিশের লোক দিয়েছেন, তারাই শুটিং-এ পুলিশের কাজ করবে। আমার মনে আর এখন কোনও সন্দেহ নেই যে কেষ্টদা ভুল শুনেছিল। জগু ওস্তাদ আসলে নির্দোষ। তাকে ভজাতে চেষ্টা করেছিল বিক্রম, কিন্তু সে রাজি হয়নি। ভাগ্যিস! মিছামিছি জগু ওস্তাদের উপর দোষ চাপালে একটা বিশ্রী ব্যাপার হত!
একটা গোলমেলে ব্যাপার এই যে, আজ সকাল থেকে মেঘলা করেছে। অবিশ্যি হাওয়া আছে বলে মেঘ মাঝে মাঝে সরে গিয়ে রোদ বেরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বিকেলে নালা টপকানোর শট-এর জন্য রোদেরই দরকার, কারণ মোটরবাইক সংক্রান্ত আর সব শটে রোদ রয়েছে। আমি বুঝি গেছি যে এখানেও সেই কনটিনিউইটির ব্যাপার। একই দৃশ্যে দশটা রোদে তোলা শট-এর সঙ্গে একটা মেঘলায় তোলা শট জুড়লে ভীষণ চোখে লাগে। তাই সকাল থেকেই মনে মনে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছি যেন বিকেলে মেঘ সরে গিয়ে রোদ বেরোয়।
দুপুরের খাওয়া শেষ করে একটা গাড়িতে আমি, কেষ্টদা, আর মেক-আপের দুজন লোক, আর অন্য গাড়িতে নতুন দুটো ক্যামেরা, তাদের ক্যামেরাম্যান আর সহকারী নালার শুটিং-এর জন্য বেরিয়ে পড়লাম। অন্যেরা সকাল-সকাল বেরিয়ে গেছে গুণ্ডাদের দৃশ্য তুলতে। তারা সেখান থেকে সোজা চলে যাবে নালার জায়গায়।
পথে হঠাৎ দেখলাম আমাদের তিন নম্বর গাড়িতে জগু ওস্তাদ আর আরও দু তিন জন লোক শুটিং সেরে সার্কিট হাউসে ফিরছে। তার মানে ছগনলালের কাজ শেষ।
সেদিনেরই মতো কুড়ি মিনিট লাগল নালার জায়গাটায় পৌঁছতে। মোটরবাইক আগেই এসে গেছে। বাসের মাথায়। কেষ্টদা আর দেরি না করে বাইকে চড়ে পড়ল। যারা আগে এসেছে তারা সবাই এখন পুরি-তরকারি লাঞ্চ করছে। কেষ্টদা বলল, আমি একবার নালাটা টপকে পেরিয়ে দেখে নিচ্ছি। স্পিডের আন্দাজটা ঠিক করে নিতে হবে।