আরও দুদিন যে কাজ করেছে কেষ্টদা তার সবই হল মোটর বাইকে আমাকে নিয়ে। যদিও মোটরবাইককে মোটর গাড়ির তাড়া করার দৃশ্যটা ছবিতে থাকবে মাত্র দেড় মিনিট, তার জন্য শট নিতে হবে প্রায় ষাট-সত্তরটা। দৃশ্যটা শেষ হবে নালার উপর দিয়ে লাফের শট দিয়ে। সেটা নেওয়া হবে আরও সাতদিন পরে। সবচেয়ে কঠিন বলে কাজটা শেষের জন্য রাখা আছে। এই শটের পরে আমারও আর কোনও কাজ বাকি থাকবে না, কেষ্টদারও না।
এটা বলতেই হবে যে, অ্যাকটিং-এর ব্যাপারে জগু ওস্তাদের কোনও গাফিলতি নেই। তাই আমার সন্দেহ হচ্ছিল কেষ্টদা ঠিক শুনেছিল কিনা। পাঁচদিনের দিন সারাদিন মোটর সাইকেলে শুটিং করার পর সার্কিট হাউসে সন্ধ্যায় একটু ফাঁক পেয়ে কেষ্টদা নিজে থেকেই এল আমার কাছে। আমি তখন সবে স্নান করে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছি। আনা সাগর লেকটা রোজ দেখেও পুরনো হয়নি। আর পাহাড়ের পিছনে সূর্যোদয়টার এক-একদিন এক-একরকম বাহার।
কী খবর? বলল কেষ্টদা।
আমি বললাম, আমি তো তোমার কাছে খবর পাব বলে বসে আছি।
লোকটা বোধহয় হাল ছেড়ে দিয়েছে, বলল কেষ্টদা, আমি ফাঁক পেলেই একবার সন্ধ্যার দিকে চায়ের দোকানটায় যাই। মাথায় চাদর মুড়ি দিয়ে বেঞ্চিতে ঘাপটি মেরে বসে থাকি। আমায় চেনা যায় না নিশ্চয়ই। সেই অবস্থায় তিনদিন জগু ওস্তাদকে ঢুকতে দেখেছি মদের দোকানে। ওর সঙ্গে অন্য দুজন গুণ্ডার একজনকে দেখেছি একদিন, কিন্তু সেই চাকর বিক্রম আর আসেনি।
তা হলে বোধহয় তুমি ভুল শুনেছিলে।
কেষ্টদা মাথা নাড়ল।
উঁহুঁ। আমার শোনায় ভুল হয়নি। ওরা যে একটা কোনও মতলব করছিল তাতে কোনও সন্দেহ। নেই। এর মধ্যে একদিন রাজবাড়িতে শুটিং-এর সময় আমার কোনও কাজ ছিল না, আমি ওদের বাড়ির একজন চাকরের কাছে একটা দেশলাই চেয়ে তার সঙ্গে একটু গল্প জুড়ে দিয়েছিলাম। সে বলল মিঃ লোহিয়ার যে খাস বেয়ারা সে নাকি ছুটিতে গেছে তিন হপ্তা হল। বিক্রম চাকরটা তার জায়গায় বদলি এসেছে। কাজেই সেখানে একটা গোলমাল আছে। এর বেলায় প্রভুভক্তির কোনও প্রশ্ন আসে না। এই লোকটাকে হাত করা তাই অনেকটা সহজ। আমার সন্দেহটা ওইখানেই। দেখা যাক; আর কদিন না গেলে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
কিন্তু সত্যি যদি কিছু হয়?
কেষ্টদা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, জানি না। যতদিন জগু ওস্তাদের কাজ আছে ততদিন আমাদের মুখ বন্ধ। সেই পাথরটা যদি চুরি যায়, তা হলে পুলিশ আসবে নিশ্চয়ই। পুলিশ যদি জগু ওস্তাদকে সন্দেহ করে তা হলে করবে–সেখানে আর কারুর কিছু বলার থাকতে পারে না। কিন্তু এটাও ঠিক যে, তা হলে তোমাদের ছবির সাংঘাতিক ক্ষতি হবে। পুলিশ দরকার বুঝলে অপরাধীকে পাকড়াও করবেই, তাদের কেউ রুখতে পারবে না। ভাবনা হচ্ছে ছবিটার জন্য। যতদূর জানি তোমার সঙ্গে জগু ওস্তাদের। বেশ কিছু কাজ বাকি আছে।
তা তো আছেই। আমাকে ধরে নিয়ে যাবার পর গুণ্ডাদের আস্তানায় আমার তিনটে দৃশ্য আছে। তারা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে, ভাল করে খেতে দিচ্ছে না। আমাকে এক-পোশাকে দিনের পর দিন থাকতে হচ্ছে–এসব তো কিছুই তোলা হয়নি এখনও।
হুঁ…
ছবিটা সম্বন্ধে কেষ্টদার এতটা দরদ আছে দেখে আমার আরও ভাল লাগল।
সত্যিই যে ভাবনার কারণ ছিল সেটা বোঝা গেল আটদিনের দিন সকালে।
সেদিন সকালে নটায় রাজবাড়িতে কাজ। আমি আর যিনি দেওয়ান সাজছেন, তাঁকে নিয়ে একটা দৃশ্য। পুলিশ গুণ্ডাদের খোঁজ করতে আরম্ভ করেছে, আর এদিকে রাজকুমার অমৃৎ তার নতুন বন্ধুর। খবরের জন্য অস্থির হয়ে পড়েছে। বড়দের বলে কোনও ফল না পেয়ে শেষটায় সে নিজেই ফোন করে ইনস্পেক্টরকে খবর জিজ্ঞেস করে। এই দৃশ্য তুলতে ঘণ্টাখানেকের বেশি সময় লাগা উচিত না। তারপর বাকি দিনটা কাজ হবে গুণ্ডাদের আস্তানায়।
সাড়ে সাতটার মধ্যে বাস বেরিয়ে পড়ল মালপত্র আর কিছু লোকজন নিয়ে। বিশুদাও চলে গেল সেই বাসে। বাকি সবাই গাড়িতে যাবে আটটার সময়। মিনিট কুড়ির মধ্যে দেখি একটা অটো-রিকশাতে করে বিশুদা ফিরে এসেছে। রাজবাড়িতে সাংঘাতিক কাণ্ড। গতরাত্রে ডাকাত পড়েছিল। মিঃ লোহিয়ার মাথায় বাড়ি মেরে তাঁকে অজ্ঞান করে তাঁর বালিশের নীচে থেকে চাবি বার করে সিন্দুক খুলে নীলকান্তমণিটা চুরি করে নিয়েছে। মিঃ লোহিয়ার স্ত্রী পাশের ঘরে দুই নাতিকে নিয়ে শুতেন, তিনি কিছুই টের পাননি। ভোরবেলা জ্ঞান হয়ে মিঃ লোহিয়া সমস্ত ব্যাপারটা জানতে পেরে স্ত্রীকে ঘুম ভাঙিয়ে বলেন।
এটাও বিশুদা বলল যে, বাড়ির একজন চাকর বিক্রমকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। সে লোহিয়ার খাস বেয়ারা শত্রুঘনের বদলি হিসাবে এসেছিল একমাসের জন্য। পুলিশ এর মধ্যেই এসে সকলকে জেরা করতে শুরু করেছে। রাজবাড়িতে আরও তিনদিনের কাজ বাকি ছিল, সেটা করতে হবে একেবারে। শেষদিকে–অন্য সব কাজ শেষ হয়ে যাবার পর।
আমি হন্তদন্ত হয়ে নীচে গিয়ে বিশুদার মুখ থেকেই সমস্ত ব্যাপারটা শুনলাম। কেষ্টদাও ছিল সেই ঘরে। সে খালি একবার আমার দিকে চাইল। আমি জানি যে এই ব্যাপারে আমাদের দুজনেরই কিচ্ছু করার নেই, যদিও আমরা সবই জানি।
ফিল্মের দলের পঁচিশজন লোকের মধ্যে শুধু আমি আর কেষ্টদাই জানি আসল ব্যাপারটা, জানি নীলকান্তমণি কোথায় কার কাছে আছে।
০৯. গুণ্ডাদের আস্তানার শুটিংটা
গুণ্ডাদের আস্তানার শুটিংটা বিকেল সাড়ে চারটায় শেষ করে ফেরার পথে বিশুদা বলল, চল অংশু, আমরা কজন একবার মিঃ লোহিয়াকে দেখে আসি। ভদ্রলোক কেমন আছেন জানা দরকার।