নীলকান্তমণির ব্যাপারটা কেষ্টদাকে বলে আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি যে ওদের কথা শুনেছ সেটা ওরা টের পায়নি তো?
মনে তো হয় না, বলল কেষ্টদা, আমি বেশিক্ষণ থাকিনি। গোলমালটা কোথায় বুঝেই আমি সটকে পড়েছি। এখন কথা হচ্ছে, এ ব্যাপারে কী করা যায়?
তুমি কি মনে করো ব্যাপারটা বিশুদাকে বলা উচিত? কেষ্টদা মাথা নাড়ল। তাতে সুবিধা হবে না। জগু ওস্তাদের কাজ এখনও বাকি আছে। ওর যদি একদিনও শুটিং না হত তা হলে ওকে বাদ দিয়ে অন্য লোক নেওয়া যেত। কিন্তু এখন ও কনটিনিউইটি হয়ে গেছে।
কী হয়ে গেছে?
কনটিনিউইটি। তার মানে ওকে নিয়ে তিনদিন কাজ হবার ফলে ওই ছগনলাল গুণ্ডা হয়ে গেছে। ওর বদলে অন্য লোক নিতে গেলে তাকে নিয়ে ওই তিনদিনের কাজ আবার নতুন করে করতে হবে। তাতে লাখ টাকা লোকসান। জগু লোকটা জোর পাচ্ছে শুধু এই কারণেই। ও জানে যে ওকে ছাড়া চলবে না। সেই সুযোগে লোকটা এই বদমাইশিটা করার তাল করছে।
তা হলে?
তা হলে মুখ বন্ধ করে বসে থাকা, আর প্রাণপণে আশা করা যাতে ওরা চুরিটা না করতে পারে। যে-মণিটার কথা বলছ সেটা কত বড়?
প্রায় একটা পায়রার ডিমের মতো।
কত দাম তা কিছু বলেছে?
বলেছে দামের কোনও হিসেব নেই। যাকে বলে অমূল্য।
বোঝো!
কেষ্টদা গম্ভীর মুখ করে চলে গেল।
রাত্তিরে খাবার পর ঘুমোত যাবার আগে একবার বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। বাইরে ঝলমলে চাঁদনি রাত, লেকের জলটা চিকচিক করছে, এমন সময় একটা শব্দ শুনে পিছনে ফিরতে হল।
বারান্দায় লোক এসেছে।
জগু ওস্তাদ। আমি তো অবাক! লোকটা যে আমারই দিকে আসছে! আমার সঙ্গে ওর কী দরকার থাকতে পারে? আর এখন তো নেশা করেছে–সমস্ত বারান্দা দুর্গন্ধে ভরে যাবে।
না, গন্ধ তো নেই। আজ দিব্যি সুস্থ লাগছে ভদ্রলোককে।
কেমন আছিস তুই?
এ আবার কী প্রশ্ন!
আমি বললাম, কেন, ভালই তো আছি।
দুপুরে শট-এর পর দেখছিলাম কোমরে হাত বুলোচ্ছিস। বেশি চোট লাগেনি তো?
না, না। এখন আর ব্যথা নেই।
ভেরি গুড। ভাবনা হচ্ছিল তোর জন্য, তাই ভাবলাম একবার খোঁজ নিই।
আমি ভাল আছি।
জগু ওস্তাদ চলে গেল।
আজ যে মানুষটাকে একদম অন্যরকম বলে মনে হল।
কেষ্টদা ঠিক শুনেছিল তো?
০৮. আরও সাতদিন কেটে গেল
এখন শুটিং-এর কাজটা বেশ মেশিন-মাফিক চলেছে। সবাইয়েরই সবকিছু সড়গড় হয়ে গেছে, তার ফলে কাজের স্পিডও বেড়ে গেছে। এর মধ্যে মা বাবা দুজনেরই চিঠি পেয়েছি। আমার কাজ ভাল হচ্ছে। জেনে দুজনেই খুব খুশি।
বিশুদা ছাড়াও আরও কয়েকজন আছে যারা রোজই একবার এসে আমার খোঁজ নিয়ে যায়। তার মধ্যে অবিশ্যি মমতামাসি একজন। উনি বেশ বুঝতে পারেন মায়ের অভাব কী জিনিস। সত্যি বলতে কি, উনি থাকাতে সুবিধাই হয়েছে, না হলে সব জিনিস সবসময় খেয়াল করা মুশকিলই হত। এ ছাড়া। আছেন সুশীলবাবু, যিনি এমনিতে একটু গম্ভীর মেজাজের লোক, কিন্তু তাও একবার অন্তত এসে কী, সব ঠিক তো? কথাটা বলে যান। সুশীলবাবুর সহকারীদের মধ্যে মুকুল চৌধুরীকে আমার এমনিতেই ভাল লাগে, কারণ কাজের সময় আমার ব্যাপারে উনি খুব বেশিরকম দৃষ্টি রাখেন। একটা শট-এ যদি আমার কুর্তার উপরের বোতামটা খোলা থাকে, তা হলে সেই দৃশ্যের অন্য সব শটেই সেটা ভোলা থাকছে কিনা সেটা দেখার ভার মুকুল চৌধুরীর উপর।
কেষ্টদার ধারণা যে ভুল সেটা আমার মনে আরও দানা বাঁধল যখন দেখলাম পর পর এই সাতদিনেও জগু ওস্তাদের দিক থেকে কোনও গোলমাল দেখা গেল না। আমি এখনও সুযোগ পাইনি, কিন্তু পেলেই একথাটা কেষ্টদাকে বলব বলে ঠিক করে রেখেছি।
সাতদিন অবিশ্যি ছবির কাজ অনেকদূর এগিয়ে গেছে। পুলকেশ ব্যানার্জি আর মমতামাসির কাজ আজ সকালেই হয়ে গেছে, ওঁরা আজ সন্ধ্যায় কলকাতা ফিরে যাবেন। ইতিমধ্যে মোহনের গরিব স্কুলমাস্টার বাবার পার্ট করার জন্য আজমীর থেকে একজন বছর চল্লিশেকের ভাল বাঙালি অ্যাকটর পাওয়া গেছে। এঁকে নিয়ে একদিনের কাজও হয়ে গেছে। কেষ্টদাকে কাজে লেগেছে এর মধ্যে তিনদিন, তার মধ্যে একদিন তাকে আরেকজন নতুন-আসা স্টান্টম্যানের সঙ্গে ফাইটিং করতে হয়েছে। আসলে ফাইটিংটা ছবিতে হবে ছগনলাল আর সূর্যকান্তের মধ্যে। তিনজনের মধ্যে একজন গুণ্ডা সূর্যকান্তের হাতে লাথি মেরে হাত থেকে পিস্তলটা মাটিতে ফেলে দিয়েছে। সেটা আবার পাবার জন্যই সূর্যকান্তকে ঘঁষোঘঁষি করতে হচ্ছে। ছগনলাল-বেশী জগু ওস্তাদ আর সূর্যকান্ত-বেশী শঙ্কর মল্লিককে গায়ে না লাগিয়ে ঘুষি চালানোর অ্যাকটিং করতে হয়েছে অবশ্যই, কিন্তু যেখানেই ঘুষি খেয়ে ছিটকে পড়ার ব্যাপার আছে, সেখানেই অ্যাকটরের বদলে স্টান্টম্যান ব্যবহার করতে হয়েছে।
গুণ্ডাদের আস্তানার জন্য শহরের একটু বাইরে একটা তিনশো বছরের পুরনো পোড়ো বাড়ি পাওয়া গিয়েছিল, তাতেই তোলা হয়েছে এইসব দৃশ্য। আমাকেও এ দৃশ্যে থাকতে হয়েছিল, কারণ মোহন তো গুণ্ডাদের হাতে বন্দি, আর তাকে উদ্ধার করতে এসেছে ইনস্পেক্টর সূর্যকান্ত। হাত পা বাঁধা অবস্থায় ঘরের এক কোণে বসে আমাকে কষ্টের অ্যাকটিং করতে হয়েছে, যদিও স্টান্টম্যানদের কারসাজি দেখে আমার বুকটা বারবার কেঁপে উঠছিল। বিশেষ করে কেষ্টদার স্টাস্টের তো কোনও তুলনাই নেই। এক-এক সময় মনে হচ্ছিল কেষ্টদার শরীরে বুঝি হাড় বলে কিছু নেইনইলে এভাবে ছিটকে ছিটকে মাটিতে পড়ছে অথচ ব্যথা লাগছে না, এটা কীভাবে হয়?