খেলি, বলল কেষ্টদা, আজ দুপুরেই খেলছিলাম। ভাল কথা–তোমাদের দলের একজন–তাকে জগু ওস্তাদ বলে ডাকে–সে কে বলো তো?
সে তো দস্যু দলের নেতা সাজছে। ও বেশ নামকরা অ্যাক্টর। আসল নাম জগন্নাথ দে।
আমি আবার ছাই বাংলা ছবি প্রায় দেখিইনি গত দশ বছরে।
কিন্তু ওর কথা হঠাৎ জিজ্ঞেস করলে কেন?
কারণ তাসের দলে ও-ও ছিল। ওই আমাকে ডেকে নিল, আমি ঘরে বসে ছিলাম। লোকটা গোলমেলে। সাংঘাতিক জোচ্চোর। কিন্তু আমার চোখে তো ধুলো দিতে পারবে না, একবারের পর দ্বিতীয়বারেই ধরে ফেলেছি। তাতে লোকটা যেরকম ভাব করল সেটা মোটেই ভাল লাগল না। এরকম মুখ-খারাপ করতে আমি খুব কম লোককে শুনেছি। ও লোক সুবিধের নয়।
সেটা যে আমার জানতে বাকি নেই সেটা গতকালের ঘটনা বর্ণনা করে আমি বুঝিয়ে দিলাম।
হুঁ… বলে কেষ্টদা কিছুক্ষণ চিন্তিতভাবে ভুরু কুঁচকে রইল। তারপর বলল, তোমার মা বাবা নেই কলকাতায়?
আমি বললাম, আছেন। আর আমার এক দিদি আছেন, তার বিয়ে হয়ে গেছে।
মা বাবাকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে না?
উঁহুঁ। বিশেষ করে এখন তুমি আসাতে আর হচ্ছে না।
গুড। কাজটা যাতে ভাল হয় সেটাই দেখতে হবে। খুব মন দিয়ে কাজ করবে। আর করলে তুমি নাম করবে সেটা আমি পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
শুধু আমি কেন, তুমিও করবে!
কেষ্টদা মাথা নাড়ল।
উঁহুঁ। স্টান্টম্যানদের নামের মোহ কাটাতে হয়। নাম করলে করবে তোমাদের হিরো, আর তাতেই যা আমাদের স্যাটিসফ্যাকশন।
কেষ্টদা উঠে পড়ল।
যাই দেখি কোনও তাসের দলে ঢুকতে পারি কিনা।
০৭. সবচেয়ে মজাদার শুটিং
তিনদিন পরে আমার সবচেয়ে মজাদার শুটিং হল পুষ্করের মেলায়। আজ প্রথম আমাকে দুটো পার্টে অভিনয় করতে হল। মোহন আর অমৃতের কথা বলার দৃশ্য দুবার করে তুলতে হল। প্রথমবার আমি মোহন সাজলাম, আর আমার সামনে অমৃতের জায়গায় দাঁড়াল শ্যামসুন্দর বলে আজমীর থেকেই নেওয়া একজন বারো বছরের ছেলে। দ্বিতীয়বার আমি সাজলাম অমৃৎ, আর সেই একই শ্যামসুন্দর দাঁড়াল মোহনের জায়গায়। দৃশ্যটা যখন লোকে পর্দায় দেখবে তখন কিন্তু শ্যামসুন্দরকে দেখাই যাবে না; তার বদলে দেখা যাবে মোহন আর অমৃৎ কথা বলছে।
কিডন্যাপিং-এর দৃশ্যটা যেখানে নেওয়া হল সেখানে মেলার কোনও ভিড় ছিল না; থাকলে খুব মুশকিল হত। জগু ওস্তাদ দিনের বেলা নেশা করেন না। তাই তিনি মগনলালের পার্টে কাজটা ভালই করলেন। তবে যেখানে মগনলাল অমৃৎবেশী মোহনকে কোলপাঁজা করে তুলে গাড়িতে নিয়ে গিয়ে ফেলছে সেটা জগু ওস্তাদ আরেকটু সাবধানে করতে পারলে। শটটা নেওয়ার পরে আমার কোমরে যে ব্যথাটা আরম্ভ হল, সেটা ছিল প্রায় সন্ধ্যা অবধি।
সন্ধ্যাবেলা সার্কিট হাউসে ফিরে এসে কেষ্টদার সঙ্গে দেখা হল। গত দুদিন সকাল থেকে রাত অবধি সব শুটিংই রাজবাড়িতে হয়েছে। সেখানে কেষ্টদা ছিল, কিন্তু কাজের পরে আমার সঙ্গে আর কথাই হয়নি। রাত করে সার্কিট হাউসে ফিরে বেশ ক্লান্ত লাগায় দুদিনই স্নান করে খেয়েই শুয়ে পড়েছি। আমার কৌতূহল ছিল জানবার জন্য এই দুদিনে কোনও বলার মতো ঘটনা ঘটেছে কিনা। আজ সন্ধ্যায় সে প্রশ্নের উত্তর পেলাম।
কেষ্টদা মুখে গুনগুন করে গান গাইলেও বেশ বুঝতে পারছিলাম ওর মাথায় কী যেন একটা চিন্তা পাক খাচ্ছে, কারণ ওর ভুরুটা ছিল কুঁচকোনো।
তোমাকেই খুঁজছিলাম, বলল কেষ্টদা।
কী ব্যাপার? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
ব্যাপার গুরুতর।
কেন বলো তো?
তোমরা তো এ-দুদিন শুটিং করছিলে রাজবাড়িতে; আমার তো সারাদিন কাজ নেই, তাই এদিক-ওদিক ঘুরছিলুম। আজমীরের কিছু দেখবার জিনিসও দেখে নিলুম। কাল রাত্তিরে আটটা নাগাদ একবার গিয়েছিলুম বাজারে। ভাবলুম ঠাণ্ডা পড়েছে, গরম চায়ে একটু গলাটা ভিজিয়ে নিই। চায়ের দোকানটা তার আগের দিনই দেখা ছিল। যাই হোক, দোকানের বাইরে বেঞ্চিতে বসে চা খাচ্ছি, এমন সময় পাশের দোকান থেকে দেখলাম দুজন লোক বেরোলো। দোকানটা মদের। দুটো লোকের মধ্যে একটা হল তোমাদের জগু ওস্তাদ, আর আরেকটাকে রাজবাড়িতে দেখেছি। চাকরের কাজ করে। নাম বোধহয় বিক্রম। চাকরটাকে ওস্তাদের সঙ্গে দেখেই মনের ভেতর একটা সন্দেহ ধক করে উঠেছে। ওরা দুজন কিন্তু বাইরে এসে চলে গেল না; কথা বলতে বলতে গেল দোকানের পিছন দিকে অন্ধকারে।
কী ঘটছে জানার জন্য প্রচণ্ড আগ্রহ হওয়াতে আমিও বেঞ্চি ছেড়ে উঠে খুব সাবধানে এগিয়ে গেলুম যেদিকে ওরা গেছে সেইদিকে। দুটো দোকানের মাঝখানে একটা গোরুর গাড়ি দাঁড়ানো ছিল। সেটার পাশে গা ঢাকা দিয়ে কয়েক পা এগোতেই জগু ওস্তাদের গলা পেলুম। বুঝলুম সে বিক্রম লোকটাকে কোনও একটা কাজে সাহায্য করার কথা বলছে। সেটা করে দিলে জগু তাকে মোটা টাকা বকশিশ দেবে। কত টাকা সেই নিয়েও কিছুক্ষণ কথা কাটাকাটি হল, শেষটায় এক হাজারে রফা হল। বুঝতেই পারছ, রাজবাড়ি থেকে কিছু চুরি করার তাল করছে ওরা। চাকরটাই চুরি করে জিনিসটা জগু ওস্তাদকে এনে দেবে, আর তার জন্য এক হাজার টাকা পাবে।
আমার কাছে এক ধাক্কায় সব জিনিসটা পরিষ্কার হয়ে গেল। নীলকান্তমণি। জগু ওস্তাদের সামনে অনেকবার মণিটার কথা হয়েছে। সেটা যে কত দামি তা সে জানে। সেইটে সে বিক্রমের সাহায্যে হাতাবার তাল করছে। আর সেটা জেনে গেছে কেষ্টদা।