শেষ পর্যন্ত কাস্টমস কিছু বলল না দেখে লালমোহনবাবু একটা হাঁপ-ছাড়া হাসি হেসেই হঠাৎ আবার গভীর হয়ে গেলেন কেন সেটা ওঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে বুঝতে পারলাম।
ফেলুদা আগেই দেখেছে লোকটাকে। একজন লালচে দাড়িওয়ালা শ্বেতাঙ্গ ঢ্যাঙ্গার সঙ্গে কথা বলছেন লাউঞ্জের কোণে দাঁড়িয়ে হয় নকল না হয় আসল বাটরা।
না, নকল নয়, আসল।
ফেলুদার সঙ্গে চোখাচে্যুখি হওয়াতে ভদ্রলোক সাহেবকে এক্সকিউস মি বলে ভুরু কপালে তুলে হেসে এগিয়ে এলেন আমাদের দিকে।
ওয়েলকাম টু কাঠমাণ্ডু!
শেষ পর্যন্ত নিজেদের তাগিদেই এসে পড়লাম, বলল ফেলুদা।
ভেরি গুড, ভেরি গুড! তিনজনের সঙ্গেই হ্যান্ডশেক করলেন ভদ্রলোক। ফরচুনেটিলি, সে লোক বোধহয় আর আমাকে ফলো করেনি, মিঃ মিটরা। এ কী দিনে আর কোনও গোলমাল হয়নি। আপনারা কী দিন আছেন?
দিন সতেক?
কোথায় উঠছেন?
হোটেল লুম্বিনীতে রিজার্ভেশন আছে।
নতুন হোটেল, বললেন মিঃ বাটরা, অ্যান্ড কোয়াইট গুড। আপনার সাইট-সিইং-এ যেতে চাইলে আমি বন্দোবস্ত করে দিতে পারি; আমার আপিস আপনাদের হোটেল থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ।
থ্যাঙ্ক ইউ। ইয়ে-এ খবরটা আপনি দেখেছেন কি? কলকাতার কাগজ এখানে আসে?
ফেলুদা পকেট থেকে একটা কাটিং বার করে বাটরার হাতে দিল। আমি জানি এটা অনীকেন্দ্ৰ সোমের খুনের খবর, স্টেটসম্যানে বেরিয়েছিল। তাতে এটাও বলা হয়েছিল যে খুনটা করা হয়েছিল একটা নেপালি কুকরির সাহায্যে।
আপনি যেদিন এলেন সেদিনকারই ঘটনা এটা।
মিঃ বাটরা খবরটা পড়ে কাগজটা থেকে চোখ তুলে গভীর সংশয়ের দৃষ্টিতে চাইলেন ফেলুদার দিকে। ফেলুদা বলল, কুকরিটা গ্র্যান্ড হোটেলের দোকান থেকে কেনা হয়েছিল খুনের আগের দিন সেটা পুলিশ ভেরিফাই করেছে! দোকানি এটাও বলে যে, যিনি কিনেছিলেন তার নাম বাটরা।
হাউ টেরিবল!
মিঃ বাটরার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
আপনি বোধহয় এই অনীকেন্দ্ৰ সোমের নাম শোনেননি?
নেভার, কাটিংটা ফেরত দিয়ে বললেন মিঃ বাটরা।
ইনি কিন্তু একই প্লেনে এসেছিলেন। আপনার সঙ্গে।
ফ্রম কাঠমাণ্ডু?
আস্তু হ্যাঁ।
নেপাল এয়ারলাইনস?
হ্যাঁ।
তা হলে চেহারা দেখলে হয়তো চিনতে পারতাম। একশো ত্ৰিশজন প্যাসেঞ্জার ছিল ওই ফ্লাইটে, মিঃ মিটরা।
যাই হাক, আপনি আর এর মধ্যে কলকাতা-টলকাতা যাবেন না, তা হলে গোলমালে পড়তে পারেন, মোটামুটি হালকা ভাবেই বলল ফেলুদা।
কিন্তু আমাকে ফাঁদে ফেলার এ রকম চেষ্টা কেন, মিঃ মিটারা? প্ৰায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন মিঃ বাটরা।
ফেলুদা বলল, একজন ক্রিমিন্যাল যদি আবিষ্কার করে যে আরেকজন লোকের সঙ্গে তার চেহারায় খুব মিল, তা হলে তার নিজের ক্রাইমের বোঝাটা সেই লোকের ঘাড়ে ফেলার চেষ্টাটা কি তার পক্ষে খুব অস্বাভাবিক?
সে তো মানছি, কিন্তু এ তো সাধারণ ক্রাইম নয়, এ যে মার্ডার।
ফেলুদা বলল, আমার ধারণা খুনি কাঠমাণ্ডুতেই ফিরে আসবে, এবং আমার সঙ্গে তার একটা মাকাবিলা হবেই। এই অনীকেন্দ্র সাম কতকটা আমার সাহায্য চাইতেই কলকাতায় গিয়েছিলেন। কী কারণে সেটা আর জানা হয়নি। তার খুনি বেকসুর খালাস পেয়ে যাবে সেটা আমি মানতে পারছি না, মিঃ বাটরা। আমি অনুরোধ করব, আপনি বা আপনার কোনও লোক যদি তাকে কাঠমাণ্ডুতে দেখেন তা হলে আমি যেন একটা খবর পাই।
সেটা আমি কথা দিচ্ছি। আপনাকে বললেন মিঃ বাটরা। আমি কালকের দিনটা থাকছি। না, একটা অ্যামেরিকান টুরিস্ট দলের সঙ্গে পোখরা যেতে হচ্ছে, পরশু ফিরে এসে আপনাকে কনট্যাকটি করব।
কাস্টমসের ঝামেলা চুকিয়ে আমরা ট্যাক্সিতে করে রওনা দিলাম। জাপানি ডাটসুন ট্যাক্সি, রাস্তায় জাপানি ও বিদেশি গাড়ির ছড়াছড়ি, পরিষ্কার চওড়া রাজপথের ধারে ইউক্যালিপটাসের সারি; পোল্লায় পার্কের মধ্যে বাহারের স্পোর্টস স্টেডিয়াম, বিরাট বিরাট বিলিতি ধাচের বিল্ডিং—যার অনেকগুলোই নাকি আগে রাণাদের প্রাসাদ ছিল—দূরে এখানে-ওখানে মাথা উচিয়ে আছে হিন্দু-বৌদ্ধ মন্দিরের চূড়ো—সব মিলিয়ে ফরেন-ফরেন ভাবটা যে ক্রমে লালমোহনবাবুকে আরও বেশি করে পেয়ে বসছে সেটা তাঁর হাত কচলানি আর আধ-বোজা চোখ দেখেই বুঝতে পারছিলাম। নেপালের রাজাই যে পৃথিবীর একমাত্র হিন্দু রাজা সেটা শুনে তিনি যেমন ইমপ্রেসড, তেমনই ইমপ্রেসড শুনে যে নেপালের লুম্বিনী শহরেই বুদ্ধের জন্ম, আর নেপাল থেকেই বৌদ্ধধর্ম গিয়েছিল চিন আর জাপানে!
শহরের মেইন রাস্তা কান্তি পথ দিয়ে বাঁয়ে ঘুরে একটা কারুকার্য করা তোরণের ভিতর দিয়ে আমরা এসে পড়লাম নিউ রোডে। এই নিউ রোডেই আমাদের হোটেল। দু দিকে দেখে বুঝলাম এটা দোকান আর হোটেলেরই পাড়া! লোকের ভিড়টাও এখানেই প্রথম চোখে পড়ল।
একটা চৌমাথার কাছাকাছি এসে আমাদের ট্যাক্সিট রাইট অ্যাবাউট টার্ন করে রাস্তার উলটাদিকে একটা বাহারের কাঠের ফ্রেমে কাচ বসানো দরজার সামনে থামল। একদিকের পাল্লার কাচে লেখা হোটেল, অন্য দিকে লুম্বিনী।
ফেলুদা এক’দিন বলছিল। ভ্রমণের বাতিকটা বাঙালিদের মধ্যে যেমন আছে, ভারতবর্ষের আর কোনও জাতের মধ্যে তেমন নেই; আর এই বাতিকটা নাকি মধ্যবিত্তদের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। সবচেয়ে আশ্চর্য এই যে, যাতায়াতের খরচ যত বাড়ছে, ভ্রমণের নেশাও নাকি বাড়ছে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে।
কাঠমাণ্ডুতে এসেও যার সঙ্গে প্রথম আলাপ হল তিনি একজন বাঙালি টুরিস্ট। হোটেলের রিশেপসনে দাঁড়িয়ে খাতায় নাম লেখা হচ্ছে, এমন সময় ভদ্রলোক পাশের একটা সোফা থেকে উঠে এগিয়ে এলেন আমাদের দিকে।