- বইয়ের নামঃ ভূস্বর্গ ভয়ংকর
- লেখকের নামঃ সত্যজিৎ রায়
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই, ফেলুদা সমগ্র
০১. ভূস্বৰ্গ
এবার কোথায় যাওয়া হচ্ছে? এক মুঠো চানাচুর মুখে পুরে চায়ে একটা চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন রহস্য রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ু—যা গনগনে গরম পড়েছে, আর তো এখানে থাকা যায় না।
কোথায় যাওয়া যায়, সেটা আপনিই বলুন না, বলল ফেলুদা। ভ্ৰমণের নেশা তো আপনার আরও প্রবল। আমি তো ইচ্ছা করলে বারো মাস কলকাতায় পড়ে থাকতে পারি।
আপনার হাতে এখন কোনও কেস নেই তো?
তা নেই।
কোথায় যেতে চাইছে আপনার মন?
পাহাড় তো বটেই; আর পাহাড় বলতে আমি হিমালয়ই বুঝি। বিন্ধ্য, ওয়েস্টার্ন ঘাট্স-এ সব আমার কাছে পাহাড়ই নয়। আমার মন যেখানে যেতে চাইছে সেখানে না গেলে নাকি জন্মই বৃথা।
কোথায়?
এত হিন্টস দিলুম তাও বুঝতে পারলেন না?
ভূস্বৰ্গ?
এগজ্যাক্টলি! কাশ্মীর! প্যারাডাইজ অন আর্থ। রোজগার তো বলতে নেই, দুজনেরই অনেক হল। সংসার আপনারও নেই, আমারও নেই। এত টাকা জমিয়ে রাখছি। কার জন্যে? চলুন বেরিয়ে পড়ি—ক্যালকাটা ঢুঁ ডেলহি, ডেলহিটু শ্ৰীনগর।
শ্ৰীনগরই তো কাশ্মীরের একমাত্র দেখার জায়গা নয়। আরও আছে।
সবই দেখা যাবে একে একে।
পাহালগাম, গুলমাৰ্গ, খিলেনমার্গ-অনেক কিছু দেখার আছে।
তা বেশ তো; দিন পনেরো হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। একটু ঘোরাঘুরি না করলে আমার মাথায় প্লট আসে না। পুজোর জন্য একটা কিছু লিখতে হবে তো!
আপনার অত অনেস্টির প্রয়োজন কী জানি না। আর পাঁচ জন যারা লিখছে, সব বিদেশি থ্রিলার থেকে প্লট সংগ্রহ করছে। ভদ্র ভাষায় বললাম, আসলে স্রেফ চুরি ছাড়া আর কিছুই না। আপনিও এবার লেগে পড়ুন।
হ্যাঁ, আমি চুরি করি আর শেষটায় আপনিই গালমন্দ করুন। আপনার কথার শ্লেষ ভুজালির চেয়েও তীক্ষ্ণ।
তা হলে যেভাবে চলছে চলুক—থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়।
তা না হয় হল, কিন্তু কাশ্মীর যাবার ব্যাপারটা কোথায় দাঁড়াচ্ছে?
উসবোটে থাকবেন তো?
শ্রীনগরে?
শ্ৰীনগর ছাড়া আর হাউসবোট নেই। ডাল লেকের উপরে থাকা যাবে।
সেই তো ভাল—তাই নয় কি? বেশ একটা নতুন অভিজ্ঞতা হবে।
অনেক খরচ কিন্তু। তার চেয়ে বোধহয় হোটেল সস্তা।
ও সব খরচের কথা শুনতে চাই না। ব্যাঙ্কে অনেক জমে আছে—ইনকাম ট্যাক্স দিয়েও। যাব—গিয়ে ম্যাক্সিমাম ফুর্তি যাতে হয়, তাই করব।
তা হলে শ্ৰীনগরে হাউসবোট, পাহালগামে তাঁবু আর গুলমার্গে লগ ক্যাবিন।
চমৎকার! টুরিস্ট অফিস থেকে লিটারেচর নিয়ে আসব, তারপর দিন ক্ষণ দেখে বেরিয়ে পডা যাবে।
*
কাশ্মীরের প্রস্তাবটা ফেলুদারও মনে ধরেছিল, সেটা আমি বুঝেছিলাম। লালমোহনবাবু ঘণ্টা দু-এক আড্ডা মেরে চলে যাবার পর ফেলুদা টুরিস্ট অফিসে গিয়ে কাশ্মীর সম্বন্ধে পুস্তিকা ইত্যাদি নিয়ে চলে এল। বলল, মনস্থির যখন করেই ফেলা হয়েছে, তখন আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই। আজ সোমবার; শনিবার নাগাত বেরিয়ে পড়া যাবে।
ঠাণ্ডা হবে না। ওখানে?
তা হবে, এবং তার জন্যে তৈরি হয়ে যেতে হবে। লালমোহনবাবু সেটা জানেন তো?
নিশ্চয়ই জানেন। তবে সাবধানের মার নেই। কাজেই ওঁকে সেটা ফোনে জানিয়ে রাখা দরকার। এমনিতেই তো শীতকাতুরে।
দু দিনের মধ্যে লক্তি থেকে আমাদের শীতের কাপড় এসে গেল। ঠিক হল প্রথমে শ্ৰীনগরেই দিন সাতেক থাকা হবে, তারপর অন্য জায়গাগুলো দেখা যাবে। হাউসবোট কাশ্মীর টুরিজম থেকে ব্যবস্থা করা হল। একটা হাউসবাটে একটা পুরো ফ্যামিলি থাকতে পারে। তাই তিনজনের পক্ষে যথেষ্ট। আমি না গিয়ে পড়া পর্যন্ত কল্পনাই করতে পারছিলাম না ব্যাপারটা কী রকম হয়। নৌকোয় থাকা! তাও আবার লাক্সারি নৌকো! বোধহয় জমিদারি আমলের বজরার মতো। পুস্তিকায় ছবি দেখে বুঝলাম যে হাউসবোটগুলো কটেজের মতো দেখতে। সেই সঙ্গে আবার ছোট ছোট নৌকোর ছবিও দেখা যাচ্ছে, যাতে করে ডাল লেকে ঘুরে বেড়ানো যায়; কারণ হাউসবোটগুলো নড়েচড়ে বেড়ায় না।
ফেলুদাকে বললাম, যা বুঝছি, শ্ৰীনগর শহরটায় দেখবার জিনিসের মধ্যে আছে কিছু বিখ্যাত মোগল বাগান। তবে পাহাড়েঘেরা উপত্যক, সব কিছুর মধ্যে দিয়ে ঝিলাম বয়ে চলেছে, তা ছাড়া দু-তিনটে লেক, পপলার, ইউক্যালিপটাস, চিনার গাছের সারি-মনে হয় জায়গাটা খুব সুন্দর। তবে গুলমার্গ পাহালগামও কিছু কম যায় না। পরে যদি ১১,০০০ ফুট খিলেনমার্গে ওঠা যায়, তা হলে সেখান থেকে নাঙ্গা পর্বতের নাকি একটা অদ্ভুত ভিউ পাওয়া যায়। পনেরো দিনের জন্য খুব জমজমাট টুর, কাজেই চিন্তা করার কিছুই নেই।
প্ল্যানমাফিক আমরা শনিবারই বেরিয়ে পড়লাম। এবার প্লেনে তিনজনের এক লাইনে সিটি পড়েনি বলে। লালমোহনবাবুকে আলাদা বসতে হল। ভদ্রলোক দেখলাম তাঁর পাশের একটি বাঙালির সঙ্গে খুব আলাপ জুড়ে দিয়েছেন। দিল্লিতে এয়ারপোর্টে এসে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার সহযাত্রীটি কে ছিলেন মশাই?
লালমোহনবাবু বললেন, নাম সুশান্ত সোম, এক রিটায়ার্ড জজের সেক্রেটারি। দলেবলে কাশ্মীর চলেছেন। ওঁরাও হাউসবোটে থাকবেন। ভদ্রলোক তোমার দাদাকে দেখেই চিনেছেন! আমাকে জিজ্ঞেস করলেন কোনও তদন্তে যাচ্ছি কি না। একবার মনে হুল বলি হ্যাঁ, তারপর মাইন্ড চেঞ্জ করে সত্যি কথাটাই বলে দিলুম।
চারিদিকে বাঙালির ভিড়, তাদের অনেকের কথাবার্তা শুনেই মনে হল তাঁরাও কাশ্মীর যাচ্ছেন। শ্ৰীনগরের প্লেন ছাড়তে আরও তিন ঘণ্টা দেরি। তার মধ্যে আমরা আর এক প্রস্ত চা খেয়ে নিলাম। রেস্টোর্যান্টে লালমোহনবাবুর আলাপী ভদ্রলোকের সঙ্গে আবার দেখা হয়ে গেল। উনি আমাদের টেবিলের দিকে হাসিমুখে এগিয়ে এলেন।