হোটেলে পৌঁছে যেটা জানা গেল তা মোটামুটি এই। রবিবার সন্ধ্যাবেলা অনীকেন্দ্ৰ সোম এসে হোটেলে ওঠেন। খাতা থেকে জানা যাচ্ছে তিনি থাকেন। কানপুরে। আগামীকাল তাঁর চলে যাবার কথা ছিল। আজ ভোর পাঁচটায় নাকি একজন লোক এসে তাঁর খোঁজ করেন। তাঁকে বলা হয় সোম থাকেন তেইশ নম্বর ঘরে। দোতলার ঘর, তাই আগস্তুক লিফটে না উঠে সিডি দিয়েই ওঠেন, আর মিনিট পনেরো বাদেই নাকি চলে যান! চেহারার বর্ণনা হল—মাঝারি হাইট, পরিষ্কার রং, দাড়ি-গোঁফ নেই, পরনে ছাই রঙের প্যান্ট আর নীল বুশ শার্ট। দারোয়ান বলল যে ভদ্রলোক নাকি একটা ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন।
মিঃ সোম আটটায় ব্রেকফাস্ট চেয়েছিলেন, রুমৰয় ঠিক সময়ে গিয়ে দরজার বেল টিপে কোনও সাড়া পায়নি। তারপর ডুপলিকেট চাৰি দিয়ে ঘর খুলে দেখে দরজার সামনেই পড়ে আছে মিঃ সোমের মৃতদেহ। অন্ত্রটা হচ্ছে একটা নেপালি কুকরি। সেটা মেরেছে বুকের মোক্ষম জায়গায়, এবং সেটাকে আর বার করা হয়নি।
তেইশ নম্বর ঘরে পুলিশ খানাতল্লাসি করছে, তবে জিনিস বলতে বিশেষ কিছুই নেই। একটি মাত্র ছোট ভি আই পি ব্যাগ, তাতে দিন-তিনেকের ব্যবহারের জন্য জামা-কাপড়। টাকা-পয়সা কিছুই পাওয়া যায়নি, অথাৎ ধরে নেওয়া যেতে পারে সেগুলো আততায়ীই সরিয়েছে। ফেলুদা লাশ দেখে এসে বলল ভদ্রলোক রীতিমতো সুপুরুষ ছিলেন, বয়স ত্ৰিশের বেশি নয়; রুমবয়ের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল মিঃ সোম সিগারেট খেতেন না, ড্রিংক করতেন না। রিসেপশনে বসেন মিঃ লতিফ, তিনি বললেন মিঃ সোম নাকি গতকাল বেশির ভাগ সময়টাই হোটেলের বাইরে ছিলেন, ফেরেন বৃষ্টি নামার ঘণ্টাখানেক আগে। আজ ভোরে ছাড়া ওঁর কাছে কোনও ভিজিটর আসেনি, কেউ টেলিফোনেও ওঁর খোঁজ করেনি। তবে হ্যাঁ, এই হোটেলের ঘরে টেলিফোন নেই, তাই মিঃ সোম নাকি কাল রাত্রে রিসেপশন থেকে ডিরেক্টরি দেখে একটা নম্বর বার করে কাকে যেন টেলিফোন করেন, এবং করার পর নিজের নোটবুকে নম্বরটা লিখে নেন।
যে নোটবুকে ফেলুদার নম্বরটা ছিল সেটা পাওয়া যায় খাট এবং বেডসাইড টেবিলের মাঝখানে মেঝেতে। নতুন কেনা নোটবুক, তার প্রথম তিনটে পাতাতেই শুধু লেখা। এলোমেলো টুকরো টুকরো কথা-বাংলা ইংরেজি মেশানো।কী মনে হচ্ছে বল তো?-একটা পাতা খুলে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল ফেলুদা।
আমি বললাম, লেখা মাঝে মাঝে কেঁপে গেছে, বিশেষ করে ঘাঁটি কথাটা তো প্রায় পড়াই যায় না।
প্রচণ্ড নাভার্স টেনশনে লিখেছেন বলে মনে হয়, মন্তব্য করলেন জটায়ু।
অথবা প্রচণ্ড বেগে ধাবমান কোনও যানে, বলল ফেলুদা, ধরুন ঘণ্টায় ছশো মাইল।
বোঝাই যাচ্ছে ফেলুদা প্লেনের কথা বলছে। জেন্টপ্লেনের স্পিড গড়ে ঘণ্টায় ছশো মাইল হতে পারে।
আমার বিশ্বাস ঘাঁটি কথাটা লেখার সময় প্লেনটা একটা এয়ার পকেটে পড়েছিল, বলল ফেলুদা।
মোক্ষম ধরেছেন, বললেন জটায়ু, সেবার বম্বে যাবার সময় মনে আছে সবেমাত্র কফিতে চুমুক দিয়েছি—আর অমনি পকেট! সে মশাই কফি অন্ননালীতে না গিয়ে শ্বাসনালীতে ঢুকে বিষমা-টিষম লেগে এক কেলেঙ্কারি ব্যাপার।
ফেলুদা লেখাগুলো নিজের খাতায় টুকে নিয়ে নেটবুকটা মহিমবাবুকে ফেরত দিয়ে দিল।
আমরা কানপুরে জানিয়ে দিচ্ছি বললেন মহিম দত্তগুপ্ত, লাশ সনাক্ত করার একটা ব্যাপার আছে তো!
ফেলুদা বলল, আমার বিশ্বাস রাত্তিরে দিল্লি থেকে একটা ফ্লাইট আছে যেটা কানপুর হয়ে আসে; গত রবিবারের ফ্রাইটে অনীকেন্দ্ৰ সোম নামে কোনও প্যাসেঞ্জার ছিল কি না সেটাও খোঁজ করে দেখতে পারেন। তবে আমার ধারণা লোকটা কোনও পাহাড়ি জায়গা থেকে আসছে।
কোন বলুন তো?
এক জোড়া মাউন্টেনিয়ারিং বুটস দেখলাম, তার একটার তলায় এক টুকরো ফার্ন লেগে রয়েছে, যেটা পাহাড়েই থাকা স্বাভাবিক।
মহিমবাবু বললেন নতুন কোনও তথ্য পেলেই জানিয়ে দেবেন, বিশেষ করে কুকরির হাতলে কোনও ফিংগার প্রিস্ট পাওয়া গেল কি না।
আর গ্র্যান্ড হোটেলে ঢুকেই প্যাসেজের বাঁদিকে একটা কিউরিওর দোকান আছে বলল ফেলুদা, খোঁজ করে দেখতে পারেন, কুকরিটা ওখান থেকেই কোনা হয়েছে কি না।
ফেরার পথে নোটবুকের তিনটে পাতায় যে লেখাগুলো ছিল সেগুলো দেখাল ফেলুদা।
প্রথম পাতায় দু লাইন লেখা–(১) only L S D কি? (২) ASK C P about methods and past cases.
দ্বিতীয় পাতায় তিন লাইন-(১) ঘাঁটি এখানে না। ওখানে? (২) A B সম্বন্ধে আগে জানা দরকার; (3) Ring up PCM, D. D. C.
তৃতীয় পাতায় শুধু আমাদের বাড়ির ফোন নম্বর।
ফরেন করেন্সি ঘটিত কোনও ব্যাপার নাকি মশাই? প্রশ্ন করলেন জটায়ু। মেট্রো ছাড়িয়ে চৌমাথায় লাল বাতিতে এসে থেমেছে আমাদের গাড়ি।
কেন বলুন তো?
না, ওই এল এস ডি দেখলাম কি না। পাউন্ড-শিলিং-পেন্স তো?
ফেলুদা—এল এস ডি হল এক রকম ড্রাগ। লাইসারাজিক অ্যাসিড ডাইয়েথিলামাইড। হিপিদের দৌলতে এর খ্যাতি এখন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। আজকাল বৈজ্ঞানিকরা বলেন, মানুষের মগজে। সেৱোটানিন বলে এক রকম রাসায়নিক পদাৰ্থ আছে যেটা মানুষকে সুস্থ মস্তিষ্কে ভাবতে বুঝতে, চিন্তা করতে সাহায্য করে; এল এস ডি নাকি সেরোটানিনের মাত্রা সাময়িকভাবে কমিয়ে দিয়ে মস্তিষ্কের বিকার ঘটিয়ে দেয়। কিছুক্ষণের জন্য মানুষ তাই একটা অবাস্তব জগতে বিচরণ করে। ধরুন, এই চৌরঙ্গিকে মনে হতে পারে নন্দনকানন।