আমার রেগুলার প্যানিক হচ্ছে, মিঃ মিটরা। সে যে কখন কী করবে তার ঠিক কী?
খুবই অদ্ভুত ব্যাপার, বলল ফেলুদা। —আপনার কথা আমার পক্ষে বিশ্বাস করাই কঠিন হত যদি না আমরা নিজের চোখে সে লোককে দেখতাম। কিন্তু তাও বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমি এ ব্যাপারে আপনাকে কীভাবে হেলপ করতে পারি সেটা ঠিক বুঝতে পারছি না।
ভদ্রলোকও চিন্তিতভাবে মাথা নেড়ে বললেন, সেটা ঠিক। এখন, আমি তো কাল কাঠমাণ্ডু ফিরে যাচ্ছি। ভরসা কী যে সে লোক আমার পিছে পিছে যাবে না, আর সেখানেও আমাকে হ্যাঁরাস করবে না? এ তো বুঝতে পারছি যে সে লোককে আমি না দেখলেও, সে আমাকে দেখেছে, আর ডেলিবারেটলি আমার পিছনে লেগেছে। দিস ইজ এ নিউ টাইপ অফ ক্রাইম, মিঃ মিটরা। এবারে হান্ড্রেড রুপিজের উপর দিয়ে বেরিয়ে গেছে, এর পরে কী হবে কে জানে?
বাইরের লোকের সঙ্গে কথা বলার সময় ফেলুদা এমনিতে পায়ের উপর পা তুলে বসে। যখন বোঝে আর কথা বলার নেই, বেশি বললে সময় নষ্ট হবে, তখন পা-টা এমন ভাবে নামিয়ে নেয় যে তাতেই বেশ বোঝা যায় এবার আপনি আসুন। আজও তাই করল, আর তাতে ফলও হল। মিঃ বাটরা উঠে পড়লেন। বুঝলাম কতকটা ভদ্রতার খাতিরেই ফেলুদা বলল, আশা করি কাঠমাণ্ডুতে গিয়ে কোনও অসুবিধায় পড়তে হবে না।
লেট আস হোপ সো, বললেন ভদ্রলোক। এনিওয়ে, আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল। আপনার খুব প্রশংসা শুনেছি মিঃ সৰ্বেশ্বর সাহায়ের কাছে।
সৰ্বেশ্বর সহায় ফেলুদার এক মক্কেল। কোডাময়ি থাকেন। হাজারিবাগে তাঁর একটা বাংলো প্রায়ই খালি পড়ে থাকে; আমরা একবার সেখানে গিয়ে ছিলাম দিন দশেক।
কাঠমাণ্ডুতে কোনও গোলমাল দেখলে আপনি পুলিশে খবর দিয়ে দেবেন, বলল ফেলুদা।এসব লোকের দরকার স্রেফ ধোলাই।
মিঃ বাটরা চলে যাবার পর লালমোহনবাবুই প্রথম মুখ খুললেন।
আশ্চর্য! ফরেন কাস্ট্রি বলেই বোধহয় এই হিল স্টেশনের কথাটা একবারও মাথায় আসেনি।
০২. অ্যাডভেঞ্চারের শুরু
পরদিন সকালে যে ঘটনাটা ঘটল, বলা যেতে পারে সেটা থেকেই আমাদের এই অ্যাডভেঞ্চারের শুরু। অবিশ্যি সেটার বিষয়ে বলার আগে গতকাল রাত্রের টেলিফোনটার কথা বলা দরকার।
কলকাতায় অকটাবর মাসেও মাঝে মাঝে আকাশ কালো-টালো করে বৃষ্টি এসে যায়। কালও তাই হল। লালমোহনবাবু সাধারণত বিকেলে এলে আটটা-সাড়ে আটটা পর্যন্ত থাকেন; কাল সাতটা নাগাদ মেঘের গর্জন শুনে হন্তদন্ত হয়ে উঠে পড়লেন–বরঞ্চ কাল সকালে আসা যাবে, তপেশ। নিউ মার্কেটের প্লটটা আরও খানিকটা এগিয়েছে; তোমার একটা ও পিনিয়ন নেওয়া দরকার।
বৃষ্টি এল আটটায়, আর ফোনটা পৌনে নটায়। ফেলুদা ওর ঘরে এক্সটেনশনে কথা বলল, আর আমি বসবার ঘরের মেইন টেলিফোনে শুনলাম।
মিস্টার প্রদোষ মিত্ৰ? ।
কথা বলছি।
ডিটেকটিভ প্রদোষ মিত্ৰ?
আজ্ঞে হ্যাঁ। প্ৰাইভেট ইনভেসটিগেটর।
নমস্কার; আমার নাম অনীকেন্দ্ৰ সোম। আমি বলছি সেন্ট্রাল হোটেল থেকে।
বলুন।
আপনার সঙ্গে একটু দরকার ছিল। একটু দেখা করা যাবে কি?
ব্যাপারটা জরুরি?
খুবই। আজ তো বাদলা, তবে কাল সকালে যদি একটু সময় দিতে পারেন। আমি বাইরে থেকে এসেছি, এবং আসার একটা প্ৰধান কারণ হল আপনার সঙ্গে দেখা করা। মনে হয় আপনি ব্যাপারটা শুনলে ইন্টারেস্টেড হবেন।
টেলিফোনে এর বেশি বলা যাবে না বোধহয়?
আজ্ঞে না। ভেরি স্যারি।
অ্যাপায়েন্টমেন্ট হল সকাল নটায়।কণ্ঠস্বরে বেশ ব্যক্তিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়, বলল ফেলুদা। আমারও অবিশ্যি তাই মনে হয়েছিল। মনে মনে বললাম—সকলে বাটরা, বিকেলে সোম—মক্কেলের কিউ লেগে গেছে।
আজকাল ফেলুদার সঙ্গে আমিও যোগব্যায়াম করি। সকাল আটটার মধ্যে স্নান-টান সেরে দুজনেই সারা দিনের জন্য তৈরি। সাড়ে আটটায় লালমোহনবাবু ফোন করে বললেন, সেদিন নিউমার্কেটে একটা দোকানের উইন্ডেগতে নাকি একটা লাইট গ্রিন জার্কিন দেখেছেন, সেইটের দরটা জেনেই আমাদের বাড়িতে চলে আসবেন। বুঝলাম ভদ্রলোক হিল স্টেশনে যাবার তোড়জোড় আরম্ভ করে দিয়েছেন।
পৌনে দশটাতেও যখন অনীকেন্দ্ৰ সোম এলেন না, তখন ফেলুদার হাত থেকে খবরের কাগজটা পাশে ফেলে মাথা নাড়ার ভাবটা দেখে বুঝলাম বাঙালিদের পাংচুয়ালিটির অভাব নিয়ে একটা তেতো মন্তব্য করার জন্য তৈরি হচ্ছে।
দশ মিনিটের মধ্যেই ফোনটা বেজে উঠল।
মার্ডার ভিকটিমের নোটবুকে আপনার ফোন নম্বর দেখছি কেন মশাই?
প্রশ্নটার মধ্যে একটা ভড়কে দেবার ভাব থাকলেও, আসলে সেটা যে হালকা মেজাজেই করা হয়েছে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না; প্রশ্নকতা হচ্ছে জোড়াসাঁকো থানার ইন্সপেক্টর মহিম দত্তগুপ্ত।
ফেলুদার কপালে খাঁজ।
কে খুন হল?
চলে আসুন সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ। সেন্ট্রাল হোটেল। তেইশ নম্বর ঘর।
অনীকেন্দ্র সোম কি?
আপনার চেনা নাকি?
পরিচয় হবার কথা ছিল আজ সকালেই। কীভাবে খুন হল?
ছুরিকাঘাত।
কখন?
আর্লি মর্নিং। এলে সব জানতে পারবেন। আমি এসেছি। এই মিনিট কুড়ি।
আমি চেষ্টা করছি আধা ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যেতে।
লালমোহনবাবু এলেন দশ মিনিট পরেই, তবে ঘরে ঢোকার আর সুযোগ পেলেন না। মার্ডার! বলে লালমোহনবাবুকে ঠেকে নিয়ে গিয়ে তাঁর গাড়িতে তুলে দিয়ে নিজে উঠে তাঁর পাশে বসে ফেলুদা ড্রাইভার হরিপদবাবুকে বলল, সেন্ট্রাল হোটেলে, চট-জলদি।
আপিসের ট্রাফিক, তার মধ্যেই যথাসম্ভব স্পিডে চলেছে আমাদের গাড়ি, আমি সামনে বসে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে দেখেই বুঝেছি লালমোহনবাবুর অবস্থা বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মতো। এটাও তিনি জানেন যে এ অবস্থায় ফেলুদাকে কোনও প্রশ্ন করেই কোনও উত্তর পাবেন না।