আমাদের গাড়ির ড্রাইভার অন্য গাড়িটার দিকে চলে গেল, আমরা তিনজন তিন ধাপ সিঁড়ি ভেঙে জাল দেওয়া দরজাটা খুলে বারান্দায় গিয়ে ঢুকলাম।
ভিতরে আসুন মিঃ মিত্তর!
সামনের ঘরটাই বৈঠকখানা, তার ভিতর থেকেই ডাকটা এসেছে। মগনলালের পালিশ করা গভীর গলাটা চিনতে অসুবিধা হয় না।
আমরা তিনজন গিয়ে বৈঠকখানায় ঢুকলাম।
ঘরের তিন দিকে সোফা, মাঝখানে একটা বড় গোল টেবিল, দেওয়ালে বাঁধানো নেপালের দৃশ্য, মেঝেতে তিব্বতি কর্পেট। এ ছাড়া পাশে একটা টেবিলের উপর একটা রেডিয়ো রয়েছে। আর এক কোণে একটা বুক শেলফে কিছু বই আর পত্রিকা।
আমাদের ঠিক সামনের সোফাটায় এক ধারে বসে মগনলাল একটা টিফিন ক্যারিয়ার থেকে পুরি আর তরকারি খাচ্ছে। একজন চাকর পাশে দাঁড়িয়ে আছে জলের জাগ আর গামলা হাতে নিয়ে।
এ ছাড়া আর কোনও তৃতীয় ব্যক্তি নেই।
আমি জানতাম। আপনি আসবেন, খাওয়া শেষ করে ভেজা তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে বললেন মগনলাল। আমরা তিনজনে ইতিমধ্যে বসে পড়েছি।
আপনি কী ব্যাপারে এসেছেন, সেটা আমি জানি মিঃ মিত্তর। বট দিস টাইম ইট ইজ মাই টার্ন! ঘুঘুতে বার বার খাবে না দানা, খাবে কি?
ফেলুদা নির্বাক।
বেনারসে আপনি যে বেইজিত করলেন আমাকে বললেন মগনলাল, সে তো আমি ভুলিনি মিঃ মিত্তর। বদলা নেবার মওকা যদি আপনি দিয়ে দেন, বদলা আমি নেব না?
একটা ধাপ ধাপ আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি মাঝে মাঝে এই বাংলোরই কোনও অংশ থেকে। মনে হচ্ছে, ডানদিকের কোনও ঘর থেকে আসছে। কীসের শব্দ বোঝা মুশকিল।
মিঃ বাটরা কোথায় সেটা জানতে পারি কি?
মগনলালের হুমকি অগ্রাহ্য করে শান্তভাবে জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।
মগনলাল আপসোসের ভঙ্গিতে চুকৃ চুক করে শব্দ করে বললেন, ভেরি সাড়, মিঃ মিত্তর। আমি তো কাল বললাম। আপনাকে-জগদীশ আমার রাইট হ্যান্ড ম্যান। রাইট হ্যান্ড তো একটাই থাকে মানুষের-দোনো কি কেয়া জরুরত?
আপনি কিন্তু আমার কথার জবাব দিলেন না। আমি জানতে চাই সে ভদ্রলোক কোথায়?
বাটরা জিন্দা আছে মিঃ মিত্তর, শেরওয়ানির পকেট থেকে পানের ডিবে বার করে দুটো পান মুখে পুরে দিয়ে বললেন মগনলাল—ডে টাইমে হি উইল বি সেফ। তেরাই-এর বেপার তো। আপনি জানেন। গরমিন্ট ল আছে কী এখানে ওয়াইলড লাইফ মারা চলবে না, লেকিন ওয়াইলন্ড লাইফ যদি মানুষ মারে, দেন হায়াট? সেটার এগনেস্টে কোনও ল আছে কি?
আপনি যে এখানে চলে এলেন, কাঠমাণ্ডুতে আজি কী হচ্ছে সেটা আপনি জানেন?
কী হচ্ছে মিঃ মিত্তর?
আপনার পাটনের কারখানা আর কাঠমাণ্ডুর শুয়োর-গলির গুদোম আজ তছনছ হয়ে যাচ্ছে।
মগনলাল সমস্ত দেহ দুলিয়ে অট্টহাসি করে উঠলেন।
আপনি কি ভাবেন আমি এত বুদ্ধ মিঃ মিত্তর? পোলিস উইল ফাইন্ড নাথিং, নাথিং। পাটনে দেখবে হ্যাঁন্ডিক্রাফট তৈয়ার হচ্ছে, আউর শুয়ার-গলিতে দেখবে গুদাম খালি! সব মাল লরিতে করে আমি সঙ্গে নিয়ে এসেছি মিঃ মিত্তর। হেতাওরা দিয়ে লরিতে মাল যায় ইন্ডিয়া। টিম্বার। সেই লরিতে করে সব দাওয়াই চলে যাবে বিহার, ইউ পি। ওষুধের অনেক কাম তো আমার ইন্ডিয়াতেই হয়। লেবেল, ক্যাপসুল, অ্যামপুল, ক্যাপ, ফায়াল, সবই তো ইন্ডিয়া থেকে আসে। বাকি কাম হয় এখানে, বিকজ এখানের লোক ইন্ডিয়ার লোকের চেয়ে কাম করে বেশি। অ্যান্ড বেটার।
আমার কানটা খুব ভাল বলেই বোধহয় ঝিঁঝির ডাক ছাপিয়ে আরেকটা আওয়াজ শুনতে পেলাম। ফেলুদার ঘাড়টা এক মুহূর্তের জন্য একবার সামান্য বাঁদিকে ঘুরতে বুঝলাম সেও আওয়াজটা পেয়েছে।
জগদীশ।
বুঝলাম মগনলাল কথা শেষ করে কাজে চলে এসেছেন।
ডান পাশের ঘর থেকে ফুলকারি করা পদ ফাঁক করে যিনি আমাদের ঘরে এসে ঢুকলেন, তার বাঁ হাতে ধরা রিভলভারটা সোজা ফেলুদার দিকে তাগ করা রয়েছে।
উঠুন আপনারা তিনজন! মগনলাল হাঁকিয়ে হুকুম দিলেন।
আমরা উঠলাম।
হাত তুলুন মাথার উপরে।
তুললাম।
গঙ্গা! কেসরী?
আরও দুজন লোক—তাদের ঠিক ভদ্র বলা যায় না—পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকে সোজা আমাদের তিনজনকে সার্চ করে ফেলুদার পকেট থেকে ওর কোল্ট রিভলভারটা বার করে মগনলালের কাছে দিয়ে দিল।
রিভলভারধারী জগদীশ ভদ্রলোকটিকে দিনের আলোতে দেখেও বাটরার সঙ্গে যে তফাতটুকু পেয়েছিলাম, তার চেয়ে বেশি পাওয়া যাচ্ছে না।
ডানদিক থেকে আবার সেই ধুপ ধুপ শব্দটা শোনা গেল। এবার মগনলাল সেদিকে একটা বিরক্ত দৃষ্টি দিয়ে বললেন, ভেরি স্যারি মিঃ মিত্তর, আপনার আর একজন ফ্রেন্ডকেও এখানে নিয়ে এসেছি আমি। উনি আমাদের ওষুধ নিয়ে ল্যাবরেটরিতে টেস্ট করে ঝামেলা করছিলেন। ন্যাচারেলি ওনাকে রোকে দিতে হল।
উনিও কি বাঘের পেটে যাবেন?
নো নো মিঃ মিত্তর, হেসে বললেন মগনলাল, ওনাকে দিয়ে আমার অন্য কাম হবে। একজন ডাকটর হাতে রাখলে সুবিধা হবে আমার, মিঃ মিত্তর। আমার নিজের হার্ট খুব ভাল নেই, সেটা আপনি বোধহয় জানেন না।
তা হলে চরণামৃততে কাজ দিল না?
মগনলাল এ কথার কোনও উত্তর দেবার আগেই গঙ্গা ও কেশরী নামে দুটো ষণ্ডা মার্কা লোক লম্বা লম্বা দড়ি নিয়ে ঘরে ঢুকে সোজা আমাদের দিকে এগিয়ে আসতেই পার পর এমন কতকগুলো ঘটনা ঘটে গেল যে সেগুলো লিখে বোঝানো খুবই কঠিন। তাও আমি চেষ্টা করছি—
প্রথমে বাইরে একটা গাড়ির শব্দতে জগদীশ ভদ্রলোক খচু শব্দে রিভলভারটার সেফটি ক্যাচুটা খুলে ফেলুদার দিকে টান করে বাড়াতেই কিছু বাঝার আগেই দেখলাম ফেলুদার ডান পা-টা একটা হাই কিক্ করে রিভলভারটাকে ভদ্রলোকের হাত থেকে ছিটকে বার করে দিল, কিন্তু তার আগে ট্রিগারের চাপ পড়ে যাওয়াতে তার থেকে সশব্দে একটা গুলি বেরিয়ে বন্ধ সিলিং ফ্যানের ব্রেডের কিনারে লেগে সেটাকে ঘোরাতে আরম্ভ করে দিল।