এ ভেরি ইম্পট্যান্ট পারসন আজ সকালে ফোন করলেন। মিঃ বাটরাকে, বললেন মিঃ প্রধান! বললেন তেরাইতে আমাদের নতুন বাংলোটা দেখার খুব ইচ্ছা। তাই মিঃ বাটরাকে ওঁর সঙ্গে চলে যেতে হল। অবিশ্যি উনি ইনস্ট্রিাকশন দিয়ে গেছেন যে আপনার গাড়ি লাগলে যেন তার ব্যবস্থা আমরা করে দিই। তার কোনও ডিফিকাল্টি হবে না।
এই ইম্পট্যান্ট পারসনটির নাম জানতে পারি কি? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
সার্টেনলি। মিঃ মেঘরাজ; ওবেরয় হোটেলে আছেন। ভেরি বিগ আর্ট ডিলার।
লালমোহনবাবু আমার হাতটা খপ করে ধরলেন। বুঝলাম মেঘরাজের নামেই ওর নেশা ছুটে গেছে। সত্যিই, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধে হয়। মিঃ বাটরা যে এত সহজেই মগনলালের ফাঁদে পড়ে যাবেন সেটা ভাবতে পারিনি।
এখান থেকে আপনাদের বাংলোয় যেতে কতক্ষণ লাগে? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
আপনাকে যেতে হবে ত্ৰিভুবন রোড দিয়ে হেতাওরা-১৫০ কিলোমিটার। হেতাওরা ইজ এ টাউন-ওখানে আপনি লাঞ্চ করে নিতে পারেন। কারণ আমাদের বাংলো নতুন, সেখানে কিচেন চালু হয়নি এখনও। টাউন থেকে ডাইনে ঘুরে রাপ্তি নদীর পাশ দিয়ে তিন কিলোমিটার গিয়ে আরও ডাইনে দু ফার্লিং গিয়েই বাংলো। জঙ্গলের মধ্যে-বিউটিফুল স্পট।
ফেলুদা আধঘণ্টা পরে হোটেলে গাড়ি পাঠাতে বলে দিল। ওকে একবার নাকি চট করে দরবার স্কোয়ারের দিকে ঘুরে আসতে হবে। বলল, তোরা হোটেলে ফিরে গিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা কর। আমার বিশ-পাঁচিশ মিনিটের বেশি লাগবে না।
গাড়ি এল কুড়ি মিনিটের মধ্যে, আর ফেলুদা পঁচিশে। বলল, ওকে নাকি একবার ফ্রিক স্ট্রিট যেতে হয়েছিল। সেটা আবার কোথায়? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
কাছেই বলল ফেলুদা, বলা যেতে পারে হিপি-পাড়া।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে শহর ছাড়িয়ে ত্ৰিভুবন রোড ধরল। আমাদের ট্যাক্সি। ফেলুদার হাতে খাতা, চোখে ভ্রূকুটি, বাইরের দৃশ্য সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন। লালমোহনবাবুর নেশা ছুটে গেলেও, একটা আশ্চর্য মোলায়েম ভাব লক্ষ করছি ওঁর মধ্যে যেটা আগে কখনও দেখিনি। মনে হয় যেন এ সব সাময়িক উত্তেজনার অনেক উর্ধের্ব উঠে গেছেন তিনি। জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখে শুধু একটা মাত্র মন্তব্য করলেন–
কাল সব ডবল দেখছিলাম, আজ সিঙ্গল।
ফেলুদা কথাটা শুনে খাতা থেকে মুখ তুলে লালমোহনবাবুর দিকে কেমন যেন অন্যমনস্কভাবে চেয়ে থেকে বলল, এটাও যেমন ঠিক, তেমন এর উলটোটাও ঠিক।
কথাটা আমার কাছে ভীষণ রহস্যজনক বলে মনে হল।
কাঠমাণ্ডুর চার হাজার ফুট থেকে আরও অনেক উপরে উঠে এসেছি। তিন পাশ ঘিরে বরফের চূড়ো দেখা যাচ্ছে। আগেই জানতাম যে সাড়ে সাত হাজার ফুট অবধি উঠতে হবে তাই ঝোলাতে করে গরম মাফলার নিয়ে নিয়েছিলাম; ঘণ্টা দেড়েক চলার পর সেগুলোর প্রয়োজন হয়ে পড়ল। সঙ্গে ফ্লাস্কে কফি ছিল, গাড়ি চালু অবস্থাতেই তিনজন খেয়ে নিলাম।
অল্পক্ষণের মধ্যেই নামা শুরু হয়ে গেল। নাড়া মহাভারত পর্বতশ্রেণী ছড়িয়ে আমরা এখন ঘন সবুজে ঢাকা শিবালিক পর্বতশ্রেণীর দিকে চলেছি। অত দূর যেতে হবে না আমাদের, কারণ মাঝপথেই পড়বে রাপ্তি উপত্যকায় নদীর পাশে হেতাওরা শহর। সেইখান থেকে ত্ৰিভুবন রাজপথ ছেড়ে ডানদিকে ঘুরব আমরা।
তোপ্সে—বাটরার পুরো নামটা জনিস?
হাতের খাতটি বন্ধ করে হঠাৎ প্রশ্ন করল ফেলুদা।
আমি বললাম, না তো, উনি তো কোনওদিন বলেননি।
না বললেও তোর জানা উচিত ছিল, বলল ফেলুদা, ওর আপিসের ঘরে ওর টেবিলের উপর একটা প্লাস্টিকের ফলকে লেখা ছিল পুরো নামটা। অনন্তলাল বাটরা।
হেতাওরা যখন পৌঁছলাম। তখন দুটো বেজে গেছে। খিদে পাবার কথা, কিন্তু পায়নি। একেকটা অবস্থায় পড়লে মানুষ খিদে-তেষ্টা ভুলে যায়, এটা সেই অবস্থা। লালমোহনবাবুকে জিজ্ঞেস করাতে বললেন, ফুড ইজ নাথিং।
ড্রাইভার রাস্তা জানে, সে ত্ৰিভুবন রোড ছেড়ে ডানদিকে ঘুরল। একটা সাইন বোর্ড দেখে বুঝলাম যে, এই রাস্তা দিয়েই ট্রি টপস হোটেলে যায়, যেখানে গাছের মাথায় বসানো হোটেলের বারান্দায় বসে তেরাই-এর বন্য জানোয়ার দেখা যায়। আমাদের বাংলো অবিশ্যি পড়বে তার অনেক আগেই।
বাঁদিক দিয়ে রাপ্তি নদী ছুটে চলেছে পাথর ভেঙে দু দিকের ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। আমাদের রাস্তারও ডানদিকে ঘন শালবন। মন বার বার বলছে, এই হল সেই তেরাই, সেই গায়ে কাটা দেওয়া অরণ্যভূমি, হিংস্ৰ জানোয়ারের ডেরা হিসেবে যার আর জুড়ি নেই। সিপাহি বিদ্রোহের পর নানাসাহেব তার দলবল নিয়ে ভারতবর্ষ থেকে পালিয়ে এসে এই তেরাইয়েরই এক অংশে গা ঢাকা দিয়ে ছিল।
রাস্তা আবার ডাইনে মোড় নিল। এটা কাঁচা, হালে তৈরি হয়েছে।
এই রাস্তা ধরে মিনিট তিনেক চালেই লাল টালির ছাতওয়ালা কালো কাঠের বাংলোটা চোখে পড়ল! বনের গাছ কেটে বেশ কিছুটা জায়গা সাফ করে কম্পাউন্ডে ঘেরা বাংলোটা তৈরি হয়েছে।
ডাইনে ঘুরে বাংলোর গেট দিয়ে ঢুকে নুড়ি ফেলা পথের উপর দিয়ে শব্দ তুলে আমাদের গাড়ি বাংলোর বারান্দার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বাঁয়ে কিছুটা দূরে কম্পাউন্ডেরই ভেতর দুটো পাশাপাশি গারাজের সামনে আর একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।
গাড়ি থামার সঙ্গে সঙ্গে জায়গাটার আশ্চর্য নিস্তব্ধতার একটা আন্দাজ পেয়েছি। বিবির শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। না, সেটা ঠিক না। একটা সামান্য খুঁটিখাট শব্দ কোত্থেকে আসছে সেটা বুঝতে পারছি না।