তপেশ ভাই, দেখেছি রং? ভিবজিওর ভাইব্রেট করছে, দেখেছ?
কথার মাঝে মাঝে যখন ফাঁক পড়ছে আর লালমোহনবাবু শুধু চুপ করে চেয়ে আছেন সামনের দিকে, সেই সময়টা আমার তন্দ্রার মতো আসছে। আবার কথা শুরু হলেই ঘুমটা ভেঙে যাচ্ছে। একবার তন্দ্রার অবস্থা থেকে মাইস বলে একটা চিৎকারে লাফিয়ে উঠে দেখি লালমোহনবাবু ভীষণ সোজা হয়ে বসে ওঁর সামনে মেঝের দিকে চেয়ে আছেন।
মাইস। আবার বললেন ভদ্রলোক। তারপর বিড়বিড়ানি শুরু হল কিছুক্ষণ—টেরামাইস, টেট্রামাইস, সুবামাইস, ক্লোরোমাইস, কমপ্রোমাইস.কিলবিল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে সব!—আমার সঙ্গে ইয়ার্কি?
শেষের কথাটা বেদম জোরে বলে। লালমোহনবাবু হঠাৎ সোফা ছেড়ে উঠে কাপেটে মোড়া মেঝেতে পায়ের গোড়ালি দিয়ে ঘা দিতে শুরু করলেন—যেন প্রত্যেকটা ইঁদুরকে পিষে পিষে মারছেন। —আবার পেখম ধরা হয়েছে! এদিক নেই। ওদিক আছে!
এইভাবে চলল মিনিট তিনেক। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে না—সারা ঘর ঘুরে ঘুরে এই কাণ্ড। আশা করি আমাদের ঠিক নীচের ঘরে কোনও গেস্ট নেই!
ব্যস, খতম।
লালমোহনবাবু বসে পড়লেন।
ঝ্যাক আবার বললেন ভদ্রলোক। —অল টিকটিকিজ খতম।
কোন ফাঁকে যে ইঁদুর টিকটিকি হয়ে গেল সেটা বোঝা গেল না।
খতম! অ্যান্টিবায়োটিকটিকিজ—খতম।
এতটা এনার্জি খরচ করার ফলেই বোধহয় লালমোহনবাবুর মধ্যে এবার একটা ঝিমধরা ভাব এসে গেল। তার সঙ্গে সেই আলাভোলা হাসি।
ওমমম, মোমোমোমোমো—ওমমম!
এর পরে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। যখন উঠলাম, তখন পুবের জানালা দিয়ে রোদ এসে ঘর একেবারে আলোয় আলো। ফেলুদা চানটান করে দাড়িটাডি কমিয়ে রেডি, সবেমাত্র কাকে যেন ফোন করে রিসিভারটা নামিয়ে রাখল।
উঠে পড়ে তোপ্সে, কাজ আছে। আজ সকালেই বাটরার সঙ্গে একবার দেখা করা দরকার। তার অবস্থাটা যে খুব নিরাপদ নয় সেটা তাকে জানানো দরকার।
ফোনটা কাকে করলে?
পুলিশ স্টেশন। ভেরি গুড নিউজ। দুই সরকারে সমঝোতা হয়ে গেছে।
এ তো দারুণ খবর!
হ্যাঁ। কিন্তু তার আগে আমি নিজে একটা ফোন করেছিলাম, সেটার খবরটা খুব ভাল না।
কেন? কাকে করেছিলে ফোন?
ডাঃ দিবাকর। উনি নাকি আজ ভোরে একটা জরুরি কল পেয়ে চলে গেছেন, এখনও ফেরেননি। ব্যাপারটা মোটেই ভাল লাগছে না।
কেন ফেলুদা?
মনে হয় উনি আমাদের হয়ে ওষুধ পরীক্ষণ করে দেখছিলেন, সেটা চোরাকারবারি দল পছন্দ করেনি। অবিশ্যি এটা আমার অনুমান; দেখি, ঘণ্টাখানেক পরে আরেকটা ফোন করে দেখব। তাতেও না হলে ডিসপেনসারিতে চলে যাব।
লালমোহনবাবুর ব্যাপারটা কতক্ষণ চলেছিল সেটা না জিজ্ঞেস করে পারলাম না।
উনি গেছেন ঘণ্টা খানেক হল, বলল ফেলুদা, পরের দিকটা একেবারে মহানিবাণের অবস্থা! কোনও উৎপাত করেননি। আসলে এল এস ডি-র প্রভাব সাত-আট ঘণ্টার কমে যায় না।
তুমি অল অ্যালং জেগে ছিলে?
উপায় কী? কখন কী করে বসে তার তো ঠিক নেই। ভাগ্য ভাল সুভদ্রলোকের কোনও খারাপ এফেক্ট হয়নি।
এখন একদম নরম্যাল?
পুরোপুরি নয়। যাবার সময় বলে গেলেন আমার মগজের নাকি তিন ভাগ স্থল, একভাগ জল। সেটা কমপ্লিমেন্ট হল কি না ঠিক বুঝলাম না। তবে খোশ মেজাজে আছেন। কোনও ডেঞ্জার নেই।
১১. হোটেল লুমুম্বা
আমি আধা ঘণ্টার মধ্যে তৈরি হয়ে নিলাম। ফেলুদা বলেছিল নীচে থাকবে, যাতে টেলিফোন এলে তৎক্ষণাৎ রিসেপশন থেকেই কথা বলতে পারে। গিয়ে দেখি ও পায়চারি করছে। বলল, এখনও ফেরেনি। ডাঃ দিবাকর। মুশকিল হচ্ছে কী, কোথায় যে গেছেন, সেটাও বাড়ির লোকে জানে না।
অরি বাটরা?
বাটরার লাইনটা পাচ্ছি না। আরও বার-দুয়েক দেখি। না হলে ব্রেকফাস্টের পর সোজা চলে যাব ওর আপিসে। এমনিতেও একটা গাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে।
মিনিট তিনেকের মধ্যেই লালমোহনবাবু এসে হাজির। কোনও তাপ-উত্তাপ নেই, যেন অস্বাভাবিক কিছুই ঘটেনি। তবে আমার সঙ্গে যে সামান্য কথাবাতা হল তাতে বুঝলাম যে চিনি এখনও সম্পূর্ণ হজম হয়নি।
রিসেপশনের দেওয়ালে টাঙানো একটা নেপালি মুখোসের নাকের উপর বার তিনেক হাত বুলিয়ে বললেন, ইংলন্ডের রাজপ্রাসাদের নামটা কী যেন ভাই তপেশ?
বার্কিংহাম প্যালেস?
ইয়েস, বললেন লালমোহনবাবু, তবে এর সঙ্গে বোধহয় কমপ্যারিজন হয় না।
কার সঙ্গে?
আমাদের এই হোটেল লুমুম্বা।
লুম্বিনী।
লুম্বিনী।
তারপর একটুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, এইখানেই তো জন্মেছিলেন, তাই না?
কে?
গৌতম বুদ্ধ?
এই হোটেলে নয় নিশ্চয়ই।
কেন, বিফোর ক্রাইস্ট হোটেল ছিল না বলছ?
এই অদ্ভুত আলোচনা আর বেশিক্ষণ চলল না, কারণ ফেলুদা এসে বলল যে চটপট ব্রেকফাস্ট সেরে বাটরার আপিস সান ট্র্যাভেলাসে যাওয়া দরকার, ওদের টেলিফোনে পাওয়া যাচ্ছে না।
ফেলুদার দেখাদেখি আমরাও শুধু কফিতে ব্রেকফাস্ট সারলাম। মন বলছে আজ অনেক কিছু ঘটবে, কিন্তু কী ঘটবে সেটা বুঝতে পারছি না।
আমাদের হোটেল থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ মিঃ বাটরার আপিস। বেশি বড় না। হলেও, বেশ ছিমছাম আপিস, দেখেই বোঝা যায় বয়স বছর-তিনেকের বেশি না। এক দেওয়ালে নেপালের রাজা-রানির ছবি, আর অন্য দেওয়ালে যার ছবি-কুঝলাম সে-ই এই অ্যাপিসের মালিক মিঃ রাণা।
আপিসে এসে যে খবরটা পেলাম সেটাকে একটা বামশেল বললেও বাড়িয়ে বলা হবে।
বাটরার ঘরে গিয়ে দেখি তিনি নেই, রয়েছেন তাঁর সেক্রেটারি মিঃ প্ৰধান। তাঁর কাছেই জানলাম যে মিঃ বাটরাকে হঠাৎ বেরিয়ে যেতে হয়েছে।