ভদ্রলোক একটু থামলেন। ফেলুদা বলল, আপনার কি ধারণা ইদানীং সে এই ধরনের আরেকটা চোরা কারবারের সন্ধান পেয়েছিল?
আমাকে সে কিছু বলেনি? বললেন। হরিনাথবাবু, তবে ও মারা যাবার দিন পাঁচেক আগে থেকে দুই বন্ধুতে উত্তেজিত হয়ে আলোচনা করতে দেখেছি। তার কিছু কিছু কথা আমার কানেও এসেছিল। আমি ওকে বলেছিলাম, তুই এসব গোলমালের মধ্যে আর যাস না। এসব গ্যাঙ বড় সাংঘাতিক হয়; এদের দয়ামায়া বলে কিছু নেই। ও আমার কথায় কান দেয়নি।
ফেলুদা গভীরভাবে মাথা নাড়ল।
ওরা যে নির্মম হয় সেটা তো অনীকেন্দ্ৰ সোমের খুন থেকেই বুঝতে পারছি।
আমার বিশ্বাস হিমু টেট্যানাসে না মরলে ওকেও হয়তো এরাই মেরে ফেলত।
এটা কেন বলছেন?
ভদ্রলোক পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বার করে ফেলুদার হাতে দিলেন। খাতার পাতা থেকে ছেঁড়া কাগজ। তাতে লাল কালি দিয়ে দেবনাগরীতে লেখা এক লাইন কথা।
এটা ছিল হিমুর একটা প্যান্টের পকেটে। ও মারা যাবার পর আমার চাকর পেয়ে আমাকে দেয়।
নেপালি ভাষা বলে মনে হচ্ছে? ফেলুদা বলল।
হ্যাঁ। ওর মোটামুটি বাংলা হচ্ছে—তোমার বাড় বড্ড বেড়েছে।
ফেলুদা কাগজটা ফেরত দিয়ে একটা শুকনো হাসি হেসে বলল, সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, জাল ওষুধের চারা কারবার বন্ধ করতে গিয়ে আপনার পুত্রকে সেই জাল ওষুধের ইনজেকশনেই মরতে হল!
আপনি তা হলে বিশ্বাস করেন যে ইনজেকশনে ভেজাল ছিল?
আমার তো তাই বিশ্বাস। সেটা ঠিক কি না সেটা কাল জানতে পারব বলে আশা করছি।
ডাঃ দিবাকরকে যে ওষুধ টেস্ট করতে বলা হয়েছে সেটা ফেলুদা হরিনাথবাবুকে বলল। ভদ্রলোক উঠে পড়লেন।
জানি না। এসব তথ্য জেনে আপনার কোনও লাভ হল কি না, দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন হরিনাথ চক্রবর্তী।
আমার মনের কিছু অস্পষ্ট ধারণা খানিকটা স্পষ্ট হল। বলল ফেলুদা।তদন্তের ব্যাপারে সেটা একটা মস্ত লাভ।
হরিনাথবাবু যাবার সঙ্গে সঙ্গে লালমোহনবাবুও গুডনাইট করে চলে গেলেন তাঁর ঘরে।
আমি শুয়ে পড়লাম, যদিও ফেলুদার হাবভাবে মনে হচ্ছে বেড-সাইড ল্যাম্প এখন জ্বলবে কিছুক্ষণ।
আজকের রাতটা কী অদ্ভুত ভাবে গেল, হিমাদ্রিবাবুর চোরা কারবারিদের ধরিয়া দেওয়া, মগনলাল কী সাংঘাতিক লোক, কী বেপরোয়াভাবে ফেলুদাকে শাসিয়ে দিল-এইসব ভাবতে ভাবতে চোখের পাতা দুটো বুজে এসেছে, এমন সময় হঠাৎ দরজার বেলটা বেজে উঠল।
সোয়া বারো। এই সময় আধার কে এল?
উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখি তাজ্জব ব্যাপার।
লালমোহনবাবু। বাঁ হাতে এক টুকরো কাগজ, ডান হাতে জপযন্ত্র। মুখের হাসিটাকে লামা-স্মাইল ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। এরকম অমায়িক, স্নিগ্ধ হাসি আজকের দিনে চট করে কোনও সেয়ানা শহুরে লোকের মুখে দেখা যায় না।
হুম, হুম, হুম!
তিনবার হুম শব্দটা উচ্চারণ করে জপযন্ত্র ঘোরাতে ঘোরাতে ভদ্রলোক ঢুকে এলেন ঘরের ভেতর।
ফেলুদা খাটে উঠে বসেছে। আমি ভদ্রলোকের হাত থেকে কাগজের টুকরোটা নিয়ে নিয়েছি। তাতে লাল কালি দিয়ে ইংরাজিতে লেখা—ইউ হ্যাভ বিন ওয়ার্নড। অর্থাৎ তোমাদের সাবধান করে দেওয়া হচ্ছে। ঠিক এই লাল কালিই দেখেছি। একটু আগে একটা নেপালি ভাষায় লেখা হুমকিতে।
কোথায় ছিল এটা? ফেলুদার হাতে কাগজটা চালান দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ভদ্রলোককে। লালমোহনবাবু তাঁর জহরকেটের ডান পকেটে দুটো চাপড় মেরে বুঝিয়ে দিলেন। ভদ্রলোক এই কেটটা পরেই বেরিয়েছিলেন সকালে। মনে পড়ল স্বয়ম্ভুনাথে বলেছিলেন বাঁদরে ওঁর পকেট ধরে টান দিয়েছিল।
ও—ম্ম্ম্ম্!
টেনে দম নিয়ে পুরো দমটা ছেড়ে শব্দটা উচ্চারণ করলেন ভদ্রলোক চেয়ারে বসতে বসতে।
ও—ম মণি পদ্মে হুম-হুম-হুমকি।
হুমকি তো বটেই, কিন্তু এ কী দশা লালমোহনবাবুর! অথচ মুখে সেই হাসিটা রয়েই গেছে।
আমি ফেলুদার দিকে চাইলাম; ও ঠোঁট নেড়ে বুঝিয়ে দিল—পাউন্ড-শিলিং-পেন্স।
এল এস ডি।
শুগার কিউব!
মগনলাল নিজের হাতেই চিনি দিয়েছিল আমাদের চায়ে। আমাদের দুজনের যখন কিছুই হচ্ছে না, তখন শুধু লালমোহনবাবুর চায়েই দিয়েছিল ওই বিশেষ একটি কিউব। আঙ্কলকে নিয়ে রসিকতা করাটা দেখছি মগনলাল চরিত্রের একটা বিশেষ দিক। কী শয়তান লোকটা!
ওঁ—ম্ম্ম্ম্মণিপদ্মে হুম্কি। আবার বললেন ভদ্রলোক। পরমুহূর্তেই হঠাৎ হাসিটা চলে গিয়ে একটা বিরক্তির ভাব দেখা দিল চাহনিতে। দৃষ্টি ফেলুদার দিকে। ফেলুদা একদৃষ্টি লক্ষ করে যাচ্ছে ভদ্রলোককে।
খুলিটা খুলে ফেলুন! ধমকের সুরে বললেন ভদ্রলোক—বলছে খুলি, অথচ খোলার নামটি নেই। হ্যাঃ!
ফেলুদা চাপা গলায় বলল, স্কাউণ্ডুল। বুঝলাম সেটা মগনলালকে উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে।
জপযন্ত্র এখন থেমে আছে। আস্তে আস্তে বিরক্ত ভাবটা চলে গিয়ে, লালমোহনবাবুর চোখ ফেলুদার উপর থেকে সরে গিয়ে চলে গেছে খাটের পাশে জলভরা গেলাসটার দিকে।
চাখের দৃষ্টি ক্রমশ তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষত্তর হয়ে এল।
আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ঘরে পিন ড্রপ সাইলেন্স। লালমোহনবাবু চেয়ে আছেন গেলাসটার দিকে; মনে হচ্ছে গেলাসটা হয়তো বা ওঁর মন্ত্রের জোরে টেবিল থেকে শূন্যে উঠে পড়বে।
আহাহা! বললেন লালমোহনবাবু। তীক্ষতা চলে গিয়ে একটা ঢুলু ঢুলু ভগব চোখে, সেই সঙ্গে তারিফের হাসি।আহাহা ভিবজিওর। আহে। আহা!—তপেশী, দেখেছি রং?
আমি থতমত খেয়ে কিছু বলার খুঁজে পাচ্ছি না। অথচ লালমোহনবাবু ছাড়বেন না। ভিবজিওর মানে হচ্ছে ভায়োলেট, ইন্ডিগো, বু, গ্ৰীন, ইয়েলো, অরেঞ্জ, রেড। অৰ্থাৎ গেলাসের জলে রামধনুর রং দেখছেন তিনি।