মগনলাল ভাসা ভাসা চোখে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি নিয়ে কিছুক্ষণ ফেলুদার দিকে চেয়ে রইলেন। আমাদের হাতে ধরা পেয়ালা থেকে ভুরিভুর করে হাই ক্লাস চায়ের গন্ধ বেরোচ্ছে; আমু আল্লাল্লমাহনবাবু এই অবস্থাতেই চুমুক না দিয়ে পারলাম না।
জগদীশ!
মগনলাল হঠাৎ হাঁকটা দেওয়াতে চমকে উঠেছিলাম। বসবার ঘরের দু দিকেই যে আরও ঘর আছে সেটা এসেই বুঝেছিলাম। এবার মগনলালের পিছনের একটা দরজা খুলে একজন লোক এসে আমাদের ঘরে ঢুকলা। সঙ্গে সঙ্গে কিড়িং করে যে শব্দটা হল সেটা লালমোহনবাবুর হাতের পেয়ালা কেঁপে গিয়ে পিরিচের সঙ্গে লাগার শব্দ।
জগদীশ নামে যে ভদ্রলোকটি মগনলালের পিছনে এসে দাঁড়ালেন, তিনি হলেন বাটরা নাম্বার টু। কাছ থেকে দেখে বাটরার সঙ্গে সামান্য তফাতটা বুঝতে পারছি। এনার চোখ একটু কটা, কানের দু পাশের চুলে সামান্য পাক ধরেছে, হয়তো শরীরে মাংসও কিছুটা বেশি। আরেকটা বড় তফাত হল, এর চাহনিতে মিশুকে ভাবটা নেই।
ইনাকে চিনেন? প্রশ্ন করলেন মগনলাল।
আলাপ হয়নি। দেখেছি, বলল ফেলুদা।
তবে শুনে রাখুন। গোয়েন্দা বাহাদুর। ইনাকে হ্যাঁরাস করবেন না। আমি জানি আপনারা ইনার পিছনে লেগেছেন। উয়ো আমি বরদাস্ত করব না। জগদীশ ইজ মাই রাইট হ্যান্ড ম্যান।
যদিও উনি নিজে যা করেন তা বাঁ হাতেই করেন।
বলিহারি ফেলুদা। এখনো নাৰ্ভ স্টেডি, গলার স্বর একটুও কাঁপছে না।
মগনলাল আর কিছু বলার আগে ফেলুদা একটা প্রশ্ন করল।
ওনার চেহারার সঙ্গে প্রায় হুবহু মিলে যায়, এমন একজন লোক কাঠমাণ্ডুতে আছে সেটা আপনি জানেন কি?
মগনলালের মুখ আরও থমথমে হয়ে উঠল।
ইয়েস মিঃ মিত্তর। আই নো দ্যাট। সে লোক যদি আপনার দাস্ত হয় তা হলে হিম টু বি ভেরি কেয়ারফুল। সে যেন বুঝে-সুঝে কাম করে। আপনি তো আজ পস্পতিনাথজির শ্মশান দেখে এসেছেন, মোহনবাবু?
লালমোহনবাবু প্ৰচণ্ড মনের জোরে মগনলালের কথা যেন শুনতে পাননি এমন ভাব; করে বাকি চা-টা ঢাকা করে খেয়ে পেয়ালাটা ঠং শব্দে পাশের টেবিলে রেখে দিলেন।
মগনলালের দৃষ্টি আবার ফেলুদার দিকে ঘুরল।
বাটরা যদি মনে করে সে তার নিজের গলতি কাম জগদীশের কানন্ধে ডালবে, তবে তাকে বলে দিবেন, মিঃ মিত্তর, কি ওই শ্মশানে তার ডেডবডির সৎকার হবে উইদিন টু ডেজ।
নিশ্চয়ই বলব।
ফেলুদাও তার চা শেষ করে কাপটা হাত থেকে নামিয়ে রাখল।
মগনলালের কথা শেষ হয়নি এখনও।
আরও একটা কথা বলে দিই মিঃ মিত্তর। আপনি দাওয়াইয়ের কথা বলছিলেন। আপনি জানেন আমাদের দেশের মানুষের সবসে বড়া দুষমন কে? অ্যালোপ্যাথ ডাকটরস্! মাইসিন জানেন তো? সিন মানে কী? সিন মানে পাপ! পাকিট ফেঁড়ে পয়সা নেবে, হাথ কেঁড়ে ব্লাড নেবে, পেট ফেড়ে পিঠা ফেড়ে বুক ফোঁড়ে এটা নেবে সেটা নেবে। ওয়ার্স দ্যান এনি স্মাগলিং র্যাকেট। পেনিসিলিনসে পাসপতিনাথের চরণামৃত ইজ হাভূড টাইমস বেটার! দেশের লোক যদি অ্যালোপ্যাথি ছেড়ে দুস্রা দাওয়াই খাবে তো আখেরে দেশের মঙ্গল হবে—এ আপনি জেনে রাখবেন!
শুনলাম আপনার কথা—ফেলুদা উঠে দাঁড়িয়েছে—কিন্তু আপনি দেখছি নিজে এখনও অ্যালোপ্যাথি ছাড়তে পারেননি। আপনার টেলিফোনের পাশে রাখা ওই শিশিটা নিশ্চয়ই চরণামৃতের শিশি নয়।
শিশিটা এমনভাবে আড়ালে রয়েছে যে প্রায় চোখেই পড়ে না।
কথাটা যে মগনলালের মোটেই পছন্দ হল না সেটা তার মুখের উপর ঝোড়ো ভাবটা নেমে আসা থেকেই বুঝেছি।
আসি, মগনলালজি। চা-টা সত্যিই ভাল ছিল।
মগনলাল তার জায়গা থেকে নড়লেন না।
যখন চারশো তেত্রিশ নম্বর সুইট থেকে বেরোচ্ছি, তখন একটা সুইচের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে শুনলাম মার্কিন ছবির সংলাপ আবার শুরু হয়েছে।
১০. মগনলালপর্বের পরে
মগনলালপর্বের পরেও একই রাত্রে যে আরও কিছু ঘটতে পারে সেটা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। অথচ লুম্বিনী হোটেলে ফেরার পর আরও দুটো এমন ঘটনা ঘটল, যার ফলে এই বিশেষ দিনটা আমার জীবনে চিরকালের মতো একটা লাল-তারিখ মাক দিন হয়ে রইল।
হোটেলে ফিরে রিসেপশনের বেঞ্চিতে হরিনাথ চক্রবর্তীকে বসে থাকতে দেখে রীতিমতো অবাক হলাম। এত রাত্রে কী ব্যাপার? বললেন প্রায় এক ঘণ্টা, মানে সাড়ে দশটা থেকে, ভদ্রলোক অপেক্ষা করছেন আমাদের জন্য, বিশেষ দরকার।
আসুন আমাদের ঘরে, বলল ফেলুদা।
ঠাণ্ডা মানুষটার মধ্যে বেশ একটা চাপা উদ্বেগের ভাব লক্ষ করছিলাম।
কী ব্যাপার বলুন তো? ঘরে এসে ভদ্রলোককে সোফায় বসিয়ে প্রশ্ন করল ফেলুদা। ভদ্রলোক একটুক্ষণ সময় নিয়ে যেন তাঁর চিন্তাগুলোকে গুছিয়ে নিলেন। তারপর বললেন, হিমাদ্রি। এইভাবে চলে যাওয়াতে সব যেন কেমন গণ্ডগোল হয়ে গিয়েছিল। আর সত্যি বলতে কী, এও মনে হচ্ছিল যে, তাকে যখন আর ফিরিয়ে আনা যাবে না, তখন এত কথা বলেই বা লাভ কী?
কীসের কথা বলছেন আপনি?
বছর তিনেক আগে, একটু দম নিয়ে বললেন হরিনাথবাবু, হিমাদ্রি এখানে একটা চারা কারবারের ব্যাপার ধরিয়ে দিয়েছিল। গাঁজা চরস ইত্যাদি গোপনে চালান যাচ্ছিল এখান থেকে। হিমাদ্রি ছিল ভয়ানক রেকলেস অ্যাডভেঞ্চার-প্ৰিয় ছেলে। নিজের জীবনের কোনও তোয়াক্কা করত না। স্মাগলিং যে হচ্ছে সেটা শোনা যাচ্ছিল, কিন্তু ঘাঁটিটা কোথায় জানা যাচ্ছিল না। আপনাকে আগেই বলেছি যে হিমাদ্রিকে হেলিকপটরে নেপালের উত্তর-দক্ষিণ দুদিকেই যেতে হত। একবার উত্তরে গিয়ে সে নিজেই অনুসন্ধান করে জানতে পারে যে ঘাঁটিটা হচ্ছে হেলাম্বুর কাছে একটা শেরপাদের গ্রামে। সে পুলিশকে খবর দেয়। ফলে দলটা ধরা পড়ে।