লালমোহনবাবু বেশ সাহেবি কায়দায় কসমোপোলিটান কথাটা বলার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমরা কলিমুদ্দির দোকানের সামনে এসে পড়লাম। এ দোকানও চেনা, সালাম বাবু বলে কলিমুদি তার কাজে লেগে গেল। দিব্যি লাগে দু হাতে ঠোঙা ধরে ঝাঁকিয়ে মেশানার ব্যাপারটা। আর সেই সঙ্গে টাটুকী, নোনতা, জিভে-জল আনা গন্ধ।
আমি গরম ঠোঙাটা হাতে নিয়েছি, এমন সময় দেখি ওয়ালেট থেকে টাকা বার করতে গিয়ে কী যেন একটা দেখে ফেলুদা একেবারে স্ট্যাচু।
কারণটা স্পষ্ট। আমাদের পাশ দিয়ে আমাদের সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে যে লোকটা এই মুহূর্তে মার্কেটের আরও ভিতর দিকে চলে গেল, সে হল মিঃ বাটরার ভূপলিকেট।
টুইনস, চাপা গলায় মন্তব্য করলেন জটায়ু।
সত্যি, যমজ ছাড়া এ রকম হুবহু মিল কল্পনা করা যায় না। তফাত শুধু শার্টের রঙে। এরটা গাঢ় নীল। হয়তো কাছ থেকে সময় নিয়ে দেখলে আরও তফাত ধরা পড়ত, কিন্তু সেও নিশ্চয়ই খুবই সূক্ষ্ম। অবিশ্যি আরেকটা তফাত এই যে ইনি ফেলুদাকে আদপেই চেনেন না।
এতে অবাক হবার কিছু নেই, ফেরাপথে রওনা দিয়ে বলল ফেলুদা, মিঃ বাটরার একটি যমজ ভাই থেকে থাকলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না।
সে আপনার নীলগিরি, বিন্ধ্য, আরাবলী, ওয়েস্টার্ন ঘাটুস—যাই বলুন না কেন, পাহাড়ের মাথায় যদি বরফ না থাকে তাকে আমি পাহাড়ই বলব না।
এবার পুজোয় পাহাড়ে যাবার কথাটা ক দিন থেকেই হচ্ছিল। নতুন উপন্যাস বেরিয়ে গেছে, লেখার তাগিদ নেই, তাই লালমোহনবাবু তার সেকেন্ড হ্যান্ড সবুজ অ্যাম্ব্যাসাডারে রোজই বিকেলে আসছেন আডিডা দিতে। কাশ্মীরটা আমাদের কারুরই দেখা হয়নি, কিন্তু ওখানকার অকটোবরের শীত সহ্য হবে না সেটা বোধহয় নিজেই বুঝতে পেরে লালমোহনবাবু দু-একবার কাশ কাশ করে থেমে গেছেন। একটা অ্যাটলাস পড়ে আছে সামনের টেবিলে চা-ডালমুটের পাশে, সেটা খুলে বোধহয় ভারতবর্ষের ম্যাপটা একবার দেখার ইচ্ছে ছিল ভদ্রলোকের, এমন সময় কলিং বেল।
শ্ৰীনাথ আমাদের বাড়িতে চোদ্দ বছর কাজ করছে, তাই মিঃ বাটরা এসে বসার সঙ্গে সঙ্গে আরেক পেয়ালা চা এসে গেল।
আপনার কি কোনও যমজ ভাই আছে?
বাটরা কপালের ঘাম মুছে রুমালটা রাখার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্নটা করলেন লালমোহনবাবু।
মিঃ বাটরার ভুরু যে কতটা ওপরে উঠতে পারে, আর তলার ঠোঁট যে কতটা নীচে নামতে পারে সেটা এই এক প্রশ্নেই বোঝা গেল।
আপনারা.আপনারা কী করে…?
আপনার সঙ্গে দেখা হবার মিনিট পাঁচ-সাতের মধ্যেই নিউ মার্কেটেই তাকে দেখেছি আমরা, বলল ফেলুদা।
মিস্টার মিটারা – চেয়ারে প্রায় এক হাত এগিয়ে এসে হাতলে একটা জবরদস্ত চাপড় মেরে বললেন মিঃ বাটরা—আই অ্যাম দি ওনলি চাইলন্ড অফ মাই পেরেন্টস। আমার ভাইবোন কিছু নেই।
তা হলো–?
সেজন্যেই তো আপনার কাছে এলাম মিঃ মিটরা। এক উইকি হল এই ব্যাপারটা আরম্ভ হয়েছে। ফ্রম কাঠমাণ্ডু। আমি কাঠমাণ্ডুর একটা ট্র্যাভেল এজেন্সিতে কাজ করি।–সান ট্র্যাভেলস-আই অ্যাম দ্য পি আর ও। আমাকে কাজের জন্য ক্যালকাটা বোম্বাই দিল্লি যেতে হয় মাঝে মাঝে। আমার অফিসের কাছে একটা ভাল রেস্টোরাল্ট আছে-ইন্দিরা-সেখানেই লাঞ্চ করি আমি এভরি ড়ে। লাস্ট ম্যানডে গেছি।-ওয়েটার বলছে, আপনি তো আধঘণ্টা আগে লাঞ্চ করে গেলেন, আবার কী ব্যাপার?–বুঝুন। মিঃ মিটরা। আরও দু-একজন চেনা লোক ছিল, তারাও বলল আমাকে দেখেছে। দেন। আই হ্যাঁড টু টেল দেম-কী আমি আসিনি। তখন ওয়েটার বলে কী, ওর সাসপিশন হয়েছিল, কারণ যে লোক খেতে এসেছিল, হি হাড় এ ফুল লাঞ্চ, উইথ রাইস অ্যান্ড কারি অ্যান্ড এভরিথিং; আর আমি খাই স্রেফ স্যান্ডউইচেজ অ্যান্ড এ কাপ অফ কফি।
মিঃ বাটরা দম নিতে থামলেন। আমরা তিনজনেই যাকে বলে উৎকৰ্ণ হয়ে শুনছি। লালমোহনবাবু বেশি মনোযোগ দিলে মুখ হাঁ হয়ে যায়, এখনও সেই অবস্থা! মিঃ বাটরা চায়ে একটা চুমুক দিয়ে আবার শুরু করলেন।
আমি কলকাতায় এসেছি। পরশু, সানডে। কাল সকলে হোটেল থেকে বেরোচ্ছি-আমি আছি গ্র্যান্ডে—ফ্র্যাঙ্ক রসে যাব টু বাইসাম অ্যাসপিরিন। আপনি জানেন বোধহয়, হোটেলের ভিতরেই একটা কিউরিওর দোকান আছে? সেইটের পাশ দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ শুনি ভিতর থেকে আমায় ডা মিঃ বাটরা, প্লিজ কাম ফর এ মোমেন্ট!—কীি ব্যাপার? গোলাম ভিতরে। সেলসম্যান একটা একশো টাকার নোট বার করে আমাকে দেখাচ্ছে। বলে-মিঃ বাটরা, আপনার এই নোটটা জাল নৌট, নো ওয়াটারমার্ক, প্লিজ। চেঞ্জ ইট —আমার তো মাথায় বাজ পড়ল মিঃ মিটরা! আমি তো দোকানে চুকিইনি! অ্যান্ড দে ইনসিসটেড, কি আমি গেছি আধা ঘণ্টা আগে, আর আমি ওই একশো টাকার নোট দিয়েছি ওদের, অ্যান্ড আই বট এ কুকরি!
কুকরি? মানে, নেপালি ছুরি? জিজ্ঞেস করলেন লালমোহনবাবু।
বুঝুন কী ব্যাপার। আমি থাকি কাঠমাণ্ডুতে; কলকাতায় এসে গ্র্যান্ড হোটেলের দোকান থেকে আমি নেপালের জিনিস কিনব কেন? নেপালে তো ও জিনিস আমি হাফ প্রাইসে পাব?
আপনাকে নোটটা বদলে দিতে হল? ফেলুদা প্রশ্ন করল।
অনেকবার বললাম, যে আই অ্যাম নট দ্য সোম পারসন। শেষকালে এমন ভাবে আমার দিকে চাইতে লাগল যেন আমি আইদার পাগল, অর ফোর টোয়েন্টি; এ অবস্থায় কী করা যায়, বলুন!
হুঁ…
ফেলুদা ভাবছে। হাতটা সাবধানে বাড়িয়ে চারমিনারের ডগা থেকে প্রায় এক ইঞ্চি লম্বা ছাইট অ্যাশট্রেতে ফেলে দিয়ে বলল, আপনি বেশ অসহায় বোধ করছেন সেটা বুঝতে পারছি।