আসুন মিঃ মিত্তর, আসুন আঙ্কল।
আমার মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছে, গলা শুকিয়ে গেছে, পেটের ভিতরটা খালি খালি লাগছে।
এ গলা যে আমাদের খুব চেনা! ফেলুদা বলেছিল এর মতো ধুরন্ধর প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে লড়েও আনন্দ। পুণ্যতীর্থ কাশীধামে এর সঙ্গে মোকাবিলা হয়েছিল ফেলুদার।
মগনলাল মেঘরাজ।
যার মাইনে করা নাইফ থ্রোয়ার লালমোহনবাবুকে টার্গেট করে খেলা দেখিয়ে ওঁর আয়ু কমিয়ে দিয়েছিল। অন্তত তিন বছর।
কাঠমাণ্ডুতে কী করছে এই সাংঘাতিক লোকটা?
০৯. মগনলালের সামনে রূপের ট্রেতে চায়ের সরঞ্জাম
আসেন! বসেন।
টিভির পাশের যন্ত্রটা থেকে একটা তার চলে গেছে ভদ্রলোকের হাতে, সেটার ডগায় একটা সুইচ। ভদ্রলোক সেটা টিপতেই শব্দ সমেত রঙিন ছবি উবে গেল।
ওয়েল, মিঃ মিটার?
আমরা দুটো সোফায় ভাগ করে বসেছি, আমার পাশে লালমোহনবাবু।
এতক্ষণে ভদ্রলোকের মুখটা খানিকটা স্পষ্ট। বিশেষ বদল হয়নি চেহারায়। ধুতিটা এখনও ছাড়েননি, তবে শেরওয়ানিটায় জাত কাটারের ছাপ রয়েছে, আর বোতামগুলো হিরের হলেও হতে পারে। সবচেয়ে বদল হয়েছে পরিবেশে; বেনারসের গলির বাড়ির গদি, আর ফাইভ-স্টার হোটেলের রয়েল সুইটে আকাশ পাতাল তফাত।
এবার রিয়েল হলিডে তো?
তার কি আর জো আছে, একপেশে হাসি হেসে বলল ফেলুদা। ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভনে, জানেন তো?
এখানে কী ধান ভানবেন আপনি মিঃ মিত্তর?
মগনলালের সামনে রূপের ট্রেতে চায়ের সরঞ্জাম। কাপে শেষ চুমুক দিয়ে সেটা নামিয়ে রেখে পাশের টেবিল থেকে ফোনটা তুলে নিলেন।
টি আর কফি? বেস্ট দাৰ্জিলিং টি পাবেন এই হোটেলে।
চা-ই হোক।
রুম সার্ভিস ডায়াল করে তিনটে চায়ের অর্ডার দিয়ে ফোন রেখে আবার ফেলুদার দিকে চাইলেন মগনলাল।
ইন্ডিয়াতে আপনি হিরো-বিগ ডিটেকটিভ। কাঠমাণ্ডু ইজ ফরেন কান্ট্রি মিঃ মিত্তর। এখানে জান-পেহচান আছে কি আপনার?
এই তো একজন পুরনো আলাপী বেরিয়ে গেল!
মগনলাল হালকা হাসি হাসলেন। দুজনের দৃষ্টি পরস্পরের দিক থেকে সরছে না।
আপনি কি সারপ্রাইজড্ হলেন আমাকে দেখে?
তা একটু হয়েছি বইকী? একটা চারমিনার ধরিয়ে দুটো রিং ছেড়ে জবাব দিল ফেলুদা।আপনি হাজাতের বাইরে দেখে নয়; ওটা আপনার কাছে কিছুই না। অবাক হচ্ছি। আপনার কর্মক্ষেত্র বদলেছে দেখে।
হোয়াই? বনারস হালি প্লেস, কাঠমাণ্ডুভি হালি প্লেস। ওখানে বিশ্বনাথজি, ইখানে পস্পতিনাথজি। একই বেপার, মিঃ মিত্তর। যেখানে ধরম, সেখানেই আমার করম। কী বলেন, আঙ্কল?
হেঁঃ হেঁঃ।
বুঝলাম হাসি ফুটলেও, কথা ফোটার অবস্থা এখনও হয়নি জটায়ুর।
করমের কথা যে বলছেন, সেটা কি ওষুধ সংক্রান্ত কোনও কাজ?
আমার শিরদাঁড়ায় একটা শিহরন খেলে গেল। বাঘের সামনে পড়ে ধরনের বেতোয়াক্কা ব্যবহার একমাত্র ফেলুদার পক্ষেই সম্ভব।
ওসূদ? মগনলাল যেন আকাশ থেকে পড়লেন।হায়ার্ট ওসূদ মিঃ মিত্তর? সূদের কারবার আমার একটা আছে ঠিকই, লেকিন ওসূদক কেয়া মতলব?
তা হলে আপনি এখানে কী করছেন সেটা জানতে পারি কি?
সার্টেনলি! লেকিন ফেয়ার এক্সচেঞ্জ হোনা চাই।
বেশ। আপনি বলুন। আমিও বলব।
আমার বেপার ভেরি সিম্পল মিঃ মিত্তর। আমি আর্টের কারবারি সেটা তো আপনি জানেন, আর নেপালে যে আর্টের ডিপো, সেটাও আপনি নিশ্চয়ই জানেন।
ফেলুদা চুপ। লালমোহনবাবু দ্রুত নিশ্বাস ফেলছেন।
এবার আপনার বেপার বলুন। ফেয়ার এক্সচেঞ্জ।
আপনি সব কথা খুলে বলেছেন বলে মনে হয় না, বলল ফেলুদা, তবে আমার কথা আমি খুলেই বলছি। আমি এসেছি একটা খুনের তদন্ত করতে।
খুন?
খুন।
ইউ মিন দ্য মার্ডার অফ মিঃ সোম?
আমি থ। ফেলুদাও থ কি না বোঝার উপায় নেই। লালমোহনবাবু শীত লাগার ভাব করে দাঁতে দাঁত চাপলেন সেটা লক্ষ করলাম। হোটেলের ভিতরের টেমপারেচারটা এমনিতেই একটু কমের দিকে। ক্যাসিনোতে লোকের ভিড়ের জন্য বলে বোধহয় ঠাণ্ডা লাগেনি।
আপনি ঠিকই ধরেছেন মগনলালজি, বলল ফেলুদা, মিস্টার অনীকেন্দ্ৰ সোম।
চা এল। মগনলালের আদেশে নতুন ট্রে থেকে শুধু তিনটে কাপ-ডিশ আর টি-পট রেখে পুরনোটা থেকে টি-পাট আর মগনলালের ব্যবহার করা পেয়ালাটা তুলে নিয়ে চলে গেল বেয়ারা।
আমার বিশ্বাস, ফেলুদা বলে চলল, সোম ভদ্রলোকটি এখানকার কোনও ব্যক্তির কিছুটা অসুবিধার সৃষ্টি করেছিল। তাই তাকে খতম করে ফেলা হল।
মগনলাল চা ঢালছেন আমাদের জন্য।
ওয়ান? টু?
মগনলালের হাতে চিনির পাত্ৰ। কিউব শুগার।
ওয়ান, আমি বললাম, কারণ প্রশ্নটা আমাকেই করা হয়েছিল।
ওয়ান?
এবার জটায়ুকে প্রশ্ন। আমি জানি জটায়ুর মাথায় এল এস ডি ঘুরছে, আর ঘুরছে সেই লোকটার কথা, যে সিঁড়ি নামছে ভেবে সাত তলার ছাতের কার্নিশ থেকে পা বাড়িয়ে দিয়েছিল।
টু? থ্রি?
নো, নো।
নো শুগার?
নো।
লালমোহনবাবু মিষ্টির ভক্ত, চায়ের দু চামচের কম চিনি হলে চলে না, তাও নো বলছেন।
ই কেমন কথা হল মোহনবাবু? আপনার রসগুল্লা খাওয়া চেহারা, শুগারে নো করছেন কেন?
আমি নিয়েছি বলেই বোধহয় ভদ্রলোক শেষ পর্যন্ত সাহস পেলেন।
ও-কে। ওয়ান।
ফেলুদারও একটা। উঠে গিয়ে যে যার চা নিয়ে এসে আবার বসলাম।
ফেলুদা চায়ের কাপটা পাশের টেবিলে রেখে আগের কথার জের টেনে বলল–আমার বিশ্বাস মিঃ সোম জানতে পেরেছিলেন যে এখানে একটা গৰ্হিত করবার চলেছে। সে ব্যাপারে তিনি কলকাতা গিয়েছিলেন। একটা উদ্দেশ্য ছিল আমার সঙ্গে দেখা করা। তার আগেই তাকে খুন করা হয়। আপনি যখন খুনের ব্যাপারটা জানেন, তখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে আপনি এ ব্যাপারে জড়িত কি না।