এসবগুলো এত দিন শুধু প্রশ্নই ছিল; শেষে কাঠমাণ্ডুতে এসে এই পুরনো আলাপীদের একজনের সঙ্গে দেখা হয়ে নেগেটিভ-পজিটিভের ঠোকাঠুকিতে যে বিস্ফোরণের সৃষ্টি হবে, সেটা কে জানত?
পাটন থেকে ফিরে ইন্দিরা রেস্টোরান্টে লাঞ্চ খেয়ে (এদের মেনুতে মোমো ছিল না) প্রায় তিনটে নাগাদ হোটেলে ফিরে দেখি ফেলুদা খাটে শুয়ে সদ্য-কোনা একটা ইংরিজি বই পড়ছে, নাম ব্ল্যাক মার্কেট মেডিসিন। আমাদের দিকে চোখ পড়তেই চোখ কপালে উঠে গেল।
ব্যাপার কী? খুব ধকল গেছে বলে মনে হচ্ছে?
দুজনে ভাগাভাগি করে পাটনের পুরো ঘটনাটা বললাম। জানতাম ফাঁকে ফাঁকে অনেক। প্রশ্ন গুঁজে দেবে ফেলুদা। বেশ বুঝতে পারছি আমরা দুজনে মিলে আজ একটা জবরদস্ত কাজ করে এসেছি। কেন তা ঠিক বলতে পারব না, সমস্ত বাড়িটার মধ্যে যেন জালিয়াতির একটা গন্ধ ছড়িয়ে ছিল। অথচ বাইরে থেকে দেখলে প্রাচীন পাটনের ইমারতি আর কাঠের কাজের তারিফ করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।
সব শুনে-টুনে ফেলুদা সাবাস বলে আমাদের দুজনেরই পিঠ চাপড়ে দিল।
গোয়েন্দাগিরিতে বীরচক্র থাকলে আমি তোদের দুজনেরই নাম রেকমেন্ড করতাম। কিন্তু আপনি যে জিনিসটা দিয়ে বাজিমাত করলেন, সেটা একবার দেখান!
লালমোহনবাবু হালকা মেজাজে থলি থেকে জপযন্ত্রটা তুলে ধরে দেখালেন।
ওর মধ্যে মন্ত্র পোরা আছে কি না সেটা দেখেছেন?
আজ্ঞে।
ওম্ মণি পদ্মে হুম্।
ख़ु?
ওম্-মণি-পদ্মে-হুম্। তিব্বতি মহামন্ত্র। এই মন্ত্রটা একটা কাগজে হাজার বার লিখে অথবা ছেপে প্রত্যেকটা জপ যন্ত্রে পুরে দেবার কথা।
পুরে দেবে? কোথায় পুরে দেবে?
ওই ওপরের জিনিসটা তো একটা কীটো। ওটার মাথাটা তো ঢাকনার মতো খুলে যাবার কথা।
তই বুঝি?
লালমোহনবাবু একটা মোচড় দিতেই মাথাটা খুলে এল।
উঁহু–নো সাইন অফ মন্ত্র।
ভেতরে কিচ্ছু নেই?
লালমোহনবাবু আর একবার ভেতরটা দেখলেন আলোর কাছে এনে।
নাথিং। –না না, দেয়ার ইজ সামথিং। কীসের যেন গুঁড়ো চক্চক্ করছে।
কই দেখি!
এবার ফেলুদা ভাল করে দেখল ভেতরটা। তারপর ল্যাম্পের পাশে বেডসাইড টেবিলের উপর উপুড় করে ধরল কৌটোটা।
কাচ। কাচের টুকরো।
একটা বড় টুকরো রয়েছে ফেলুদা?
দেখেছি।
মনে হয় একটা ছোট্ট পাইপ জাতীয় কিছুর অংশ। ফেলুদা মাথা নাড়ল।
পাইপ নয়। অ্যামপুল। অসাবধানে ভেঙে ফেলাতে এই পুরো জিনিসটাকে বাতিল করে দিয়েছে।
তার মানে বলছেন এই জপ যন্ত্রের মধ্যে জাল ওষুধ চালান হত?
কিছুই আশ্চর্য না। জপ যন্ত্রের ভিতর পুরে প্যাকিং কেসে করে জমা হত পিগ অ্যালির তিব্বতি দোকগনের দোতলায়। সেখান থেকে নিশ্চয়ই চলে যেত হালসেলারদের কাছে। তারপর সেখান থেকে দাওয়াখানায়। যে বাক্সগুলো কাল ওই হোটেলেক্স ঘর থেকে দেখেছিলি, আর আজ টেম্পোতে যে বাক্সগুলো তুলছিল—সে কি একই রকম?
আইডেনটিক্যাল, উত্তর দিলেন জটায়ু।
বুঝেছি—ফেলুদার কপালে ত্ৰিশূলের মতো দাগ—সাপ্লাইয়ের ব্যাপারটা তদ্বির করছে নকল বাটরা। আর ব্যাপারটা যদি বড় স্কেলে হয়, তা হলে হয়তো বেশ কিছু মাল চলে যাচ্ছে সীমানা পেরিয়ে ভারতবর্ষে। বিহার, ইউ পি-র ছোট ছোট শহরে কত লোক এই ভেজাল ওষুধ খায় আর ভেজাল ইনজেকশন ব্যবহার করে তার হিসেব কে রাখছে? ডাক্তারের সন্দেহ হলেও সে যে শোরগোল তুলবে না। সে তো দেখাই গেল। এই যুগটাই যে ওই রকম। চাচা আপন প্ৰাণ বাঁচা।
ফেলুদা খাট থেকে উঠে কিছুক্ষণ বেশ তেজের সঙ্গে পায়চারি করে নিল। লালমোহনবাবু আবার জপ যন্ত্রে ঢাকনা পরিয়ে সেটা হাতে নিয়ে ঘোরাচ্ছেন। ফেলুদার অ্যাডভেঞ্চারে অনেক সময়ই তিনি কেবল দর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন; আজ তিনি যাকে বলে স্বয়ং রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ।
ঘড়িতে দেখি পৌনে চারটে। আমি লালমোহনবাবুকে মনে করিয়ে দিলাম যে এতক্ষণে তাঁর প্যান্ট রেডি হয়ে থাকার কথা।
এইদ্দ্যাখো। ভুলেই গেস্লাম।
ভদ্ৰলোক এক লাফে সোফা থেকে উঠে পড়লেন। আজি ক্যাসিনো যাচ্ছি। তো আমরা? ট্রাউজারটা কিন্তু সেই উদ্দেশ্যেই করানো।
ফেলুদা পায়চারি থামিয়ে একটা তালি মেরে মন থেকে যেন সমস্ত চিন্তা দূর করে দিয়ে বলল, গুড আইডিয়া। আজকে উই ডিজার্ড এ হলিডে। ডিনারের পরে এক ঘণ্টা ক্যাসিনোয় যাপন।
অবিশ্যি ক্যাসিনো-পর্ব এক ঘণ্টায় শেষ হয়নি। কেন হয়নি সেটা জানতে হলে আর একটু ধৈর্য ধরতে হবে।
সাড়ে আটটার মধ্যে ডিনার খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ক্যাসিনো খোলা থাকে নাকি ভোর চারটে অবধি, আর আসল ভিড়টা হয় এগারেটার পর থেকে। এখন গেলে খানিকটা খালি পাওয়া যাবে।
হোটেলটা শহর থেকে খানিকটা বাইরে। বাসে যেতে যেতে বেশ বুঝতে পারছিলাম যে আমরা লোকালয় ছড়িয়ে চলে যাচ্ছি, কারণ রাস্তার আলো ছাড়া আর বিশেষ আলো চোখে পড়ছে না।
মিনিট পনেরো চলার পর খানিকটা চড়াই উঠে একটা গেট পড়ল। তারপর ডাইনে বেশ বড় একটা লন ও সুইমিং পুল পেরিয়ে আবার ডাইনে ঘুরে বাসটা গিয়ে থামল হোটেলের পোটিকের ঠিক আগে একেবারে ক্যাসিনোর প্রবেশদ্বারের সামনে। পোল্লায় হোটেলের এক পাশটায় এই ক্যাসিনো। বুঝলাম যারা বাইরে থেকে আসবে তাদের আর আসল হোটেলে ঢুকতেই হবে না।
আমাদের আজকের হিরো-অন্তত এখন পর্যন্ত-হলেন লালমোহনবাবু। বিদেশি ফিল্মে দেখা আদব-কায়দার কোনওটাই বাদ দেবেন না। এমন একটা সংকল্প নিয়েই যেন তিনি ক্যাসিনোতে এসেছেন। অবিশ্যি এসব আদব-কায়দা যে তিনি সব সময় ঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পেরেছিলেন তা নয়। যেমন, সুইং ডোর দিয়ে ঢুকেই বাঁয়ে কাউন্টারের পিছনে যে দুটি বো-টাই পরা ভদ্রলোক বসে ছিলেন-যাদের কাছে হোটেল থেকে পাওয়া পাঁচ ডলারের কার্ডটা দেখিয়ে তবে ক্যাসিনোয় ঢুকতে হয়–তাদের দিকে চেয়ে রীতিমতো গলা তুলে হেলালো বলাটা ঠিক বিলিতি কেতার মধ্যে বোধহয় পড়ে না। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে যে কাঠমাণ্ডুর টেলার ভদ্রলোকের প্যান্ট বেশ ভালই বানিয়েছে। তার সঙ্গে নিউ মার্কেটে কেনা হালকা সবুজ জার্কিন আর মাথায় নেপালি ক্যাপ—সব মিলিয়ে ভদ্রলোকের মধ্যে বেশ একটা স্মার্টনেসের ভাব এসেছে সেটা স্বীকার করতেই হবে।