দরজাটা বন্ধ।
বাড়িটার এদিকের দেওয়ালে এই একটাই দরজা।
এই দরজা দিয়েই ভিতরে ঢুকেছে লোকটা।
আরও দশ পা গিয়ে বাড়িটা শেষ হয়েছে; তার পাশ দিয়ে একটা গলি বাঁয়ে চলে গেছে। একটা ছড়-টানা বাজনার শব্দ আসছে। মনে হল গলিটা থেকেই।
এগিয়ে গেলাম গলিটার মুখ অবধি। এদিকটা একেবারে নির্জন।
গলির ডাইনে, আমাদের থেকে দশ-বারো হাত দূরে, একটা ভিখিরি একটা বাড়ির রোয়াকে বসে সারিন্দা বাজাচ্ছে। লোকটা নেপালি, কারণ সারিন্দা নেপালের যন্ত্র, তিব্বতের নয়। অবিশ্যি এই রকমই যন্ত্র একই নামে পূর্ববঙ্গেও পাওয়া যায়।
যতটা সম্ভব টুরিস্টের ভাব করে এগিয়ে গেলাম গলি ধরে। লোকটার সামনে একটা মরচে-ধরা টিনের কৌটো। যেখানে বসেছে, তার উলটোদিকে একটা দরজা। এটা সেই একই বাড়ির দরজা, যার সামনের দিকে দোকান থেকে জপযন্ত্র চালান যাচ্ছে কাঠমাণ্ডু। এই বাড়িতেই ঢুকেছে শুয়োর-গলির সেই তিব্বতি।
ভিখিরি এক মনে বাজিয়ে চলেছে তার নেপালি গৎ, আমাদের সম্বন্ধে তার কোনও কৌতুহল নেই।
লালমোহনবাবু টিনের কৌটোটায় কয়েকটা খুচরো পয়সা ফেলে দিয়ে চাপা গলায় বললেন, যাবে নাকি ভেতরে?
এ দরজাটা খোলা। এটা সাইজেও ছোট আর এটার বাহারও কম, কারণ এটা হল। ব্যাকডোর, যাকে বলে খিড়কি।
চলুন।
যদি জিজ্ঞেস করে তো কী বলবো?
বলব টুরিস্ট, ভেতরে কী আছে দেখতে এসেছি।
চলো।
ভিখিরিটার দিকে একটা আড়পৃষ্টি দিয়ে, গলিতে আর কোনও লোক নেই দেখে আমরা দুজনে মাথা হেঁট করে দরজাটা দিয়ে ভেতরের প্যাসেজে ঢুকলাম।
প্যাসেজটা পেরিয়ে ডাইনে একটা উঠোনের এক চিলতে দেখা যাচ্ছে। তারও ডাইনে নিশ্চয়ই ঘর আছে। সেই ঘরের দিক থেকেই শব্দটা আসছে।
যান্ত্রিক শব্দ।
না, ঠিক যান্ত্রিক না। যদি বা একটা মেশিন গোছের কিছু চলে, তার সঙ্গে আরও কয়েকটা শব্দ মিশে আছে। মোটামুটি বলা যায় যে শব্দটার মধ্যে একটা তাল আছে।
আমার দম বন্ধ করে পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলাম।
বাঁয়ে একটা দরজার পিছনে অন্ধকার ঘর।
একটা পায়ের শব্দ পাচ্ছি। ডানদিক থেকে আসছে সেটা। শব্দটা বাড়ছে।
হঠাৎ খেয়াল হল যে এর মধ্যে কখন জানি সারিন্দার সুর পালটে গেছে! আগেরটা ছিল করুণ, মোলায়েম, এটা নাচনি, হালকা সুর।
এবারে যে লোকটা আসছে তাকে দেখা যাবে।
গলা শুকিয়ে গেছে।
বুঝলাম লোকটা যদি কিছু জিজ্ঞেস করে তো গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোবে না।
আর চিন্তা না করে এক ঝটিকায় লালমোহনবাবুকে টেনে নিয়ে দুজনে ঢুকে পড়লাম বাঁ পাশের অন্ধকার ঘরটায়। রাস্তার দিকের একটা খুপরি জানালা দিয়ে ঘরে সামান্য আলো আসছে, তাতে দেখা যাচ্ছে একটা খাটিয়া, একটা তামার পাত্র, দড়িতে ঝোলানো কিছু জামা-কাপড়।
আমরা দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনলাম পায়ের শব্দটা বাইরে প্যাসেজ দিয়ে রাস্তার দিকে চলে গেল।
সারিন্দা থেমেছে। তার বদলে গলার আওয়াজ পেলাম। লোকটা বাইরে গিয়ে ভিখিরিটার সঙ্গে কথা বলছে।
আমাদের ডাইনে আর একটা দরজার পরে আর একটা ঘর। এটাও অন্ধকার।
জটায়ুর আস্তিন ধরে টেনে নিয়ে সেই ঘরে ঢুকলাম।
কাঠ ও কার্ডবোর্ডের বাক্সে বোঝাই ঘরটা। তা ছাড়া আছে কিছু তামার জিনিস, কিছু মূর্তি, গোটা কুড়ি-পঁচিশ কাঠের ছাঁচ। বাঁয়ে ঘরের কোনায় পড়ে আছে লালমোহনবাবুর শখের জিনিস-তিনটে কাঠের জপযন্ত্র।
আমরা ঢুকেই বাঁয়ে দরজার আড়ালে লুকিয়ে পড়েছি। বেশ বুঝতে পারছি, এ ঘরের বাইরেই বারান্দা পেরিয়ে উঠোন, আর উঠোনের ওদিকের ঘর থেকেই শব্দটা আসছিল।
এখন শব্দ নেই!
এবার একটা নতুন শব্দ।
লোকটা বাইরে থেকে ফিরে এসেছে।
সে খুঁজছে আমাদের।
প্যাসেজ ধরে পায়ের শব্দ এগিয়ে গিয়ে কাউকে না পেয়ে আবার ফিরে এল। যে ঘরে আছি, সে ঘরের ডাইনের দেওয়ালে উঠোনের দিকে পর পর তিনটে দরজা। দরজার বাইরে থেকে আসা আলো তিনবার বাধা পেল সেটা দেখতে পেলাম।
এবারে আমাদের ঠিক পাশের দরজার সামনে এসে পায়ের শব্দটা থামল।
একটা আবছা ছায়া ঢুকে এল ঘরের ভিতরে চৌকাঠ পেরিয়ে।
আমার দম বন্ধ! শরীরের সব শক্তি জড়ো করে তৈরি হচ্ছি। যা করবার আমাকেই করতে হবে।
লোকটা আর দু পা এগোতেই আমাদের দেখতে পেল।
ওর প্রথম হকচকানিটা কাটবার আগেই আমি ডাইভ দিয়ে পড়লাম লোকটার উপর। হাত দুটো সমেত কোমর জাপটে ধরে ঘুরিয়ে দেয়াল-ঠাসা করব।
কিন্তু লোকটা ষণ্ডী। এক ঝটিকায় হাত দুটোকে ছাড়িয়ে নিয়ে আমার কোটের লেপেল দুটো দু হাতের মুঠোয় ধরে এক হাঁচিকায় মাটি থেকে শূন্যে তুলে ফেলল আমায়। বোধহয় ইচ্ছে ছিল ছুড়ে ফেলবে, কিন্তু লালমোহনবাবু সে ব্যাপারে বাগড়া দিচ্ছেন। আমাদের দুজনের মাঝখান দিয়ে হাত গলিয়ে দিয়ে লোকটার হাত দুটোকে আমার কোট থেকে ছাড়াবার চেষ্টা করছেন।
কিন্তু পারলেন না।
লোকটার কনুইয়ের ধাক্কা লালমোহনবাবুকে ছিট্কে ফেলে দিল কার্ডবোর্ডের বাক্সের স্তূপের ওপর।
আমার দু হাতের তেলো লোকটার থুতনির তলায় রেখে উপর দিকে চাড় দিয়ে মাথাটাকে চিতিয়ে দিয়েছি, কিন্তু বুঝতে পারছি আমি এখনও শূন্যে, এখনও লোকটা আমাকে ধরে—।
ঠকাং!
হাত দুটো আলগা হয়ে গেল। আমার পায়ের তলায় আবার মাটি। লোকটা দুমড়ে মুচড়ে মাটিতে পড়ল অজ্ঞান হয়ে।
মাথায় বাড়ি।
জপ যন্ত্রের বাড়ি।
পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে আমরা দুজনে আবার রাস্তায়, জপযন্ত্র লালমোহনবাবুর থলিতে।
০৮. পুরনো অ্যাডভেঞ্চারগুলো সম্বন্ধে আলোচনা
কলকাতায় আমাদের বাড়িতে বসে আমি আর ফেলুদা অনেক সময় আমাদের পুরনো অ্যাডভেঞ্চারগুলো সম্বন্ধে আলোচনা করেছি, বিশেষ করে তাদের সম্বন্ধে, যাদের শয়তানি বুদ্ধি ফেলুদাকেও মাঝে মাঝে প্যাচে ফেলে দিয়েছিল। লখনউ-এর বনবিহারী সরকার, কৈলাসের মূর্তি চার, সোনার কেল্লার বর্মন আর মন্দার বোস, মিঃ গোরে, কাশীর মগনলাল মেঘরাজ—এরা সব কোথায়? কী করছে? ভোল পালটে সৎপথে চলছে, না শয়তানির মওকা খুঁজছে? নাকি অলরেডি আরম্ভ করে দিয়েছে শয়তানি?