ডাঃ দিবাকর ধীরে ধীরে উঠে পড়লেন চেয়ার থেকে।কাল একটা জরুরি কেস আছে—দরজার দিকে যেতে যতে বললেন ভদ্রলোক—আক্ল সম্ভব না হলে পরশু জানাব।
আপনাকে অজস্র ধন্যবাদ; এবং আপনাকে এভাবে উত্ত্যক্ত করার জন্য আমি ক্ষমা চাইছি।
আমরা যে একটা সাংঘাতিক গোলমেলে ব্যাপারের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছি সেটা বেশ বুঝতে পারছি। আর, যতই নতুন নতুন ব্যাপার শুনছি, ততই অনীকেন্দ্ৰ সোম লোকটার উপর শ্রদ্ধা বেড়ে যাচ্ছে। এমন একজন লোকের এভাবে খুন হওয়াটা যে ফেলুদা কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারবে না সেটা খুবই স্বাভাবিক; কুকরিটার জন্য দু নম্বর বাটরাকেই খুনি বলে মনে হয়; কিন্তু তা না হয়ে যদি অন্য কেউও হয়, ফেলুদা তাকে শায়েস্তা না করে ছাড়বে না।
ফেলুদা আগেই বলে রেখেছিল যে খাবার পরে একবার ঘুরতে বেরোবে, তবে সেটা কী উদ্দেশ্যে সেটা আন্দাজ করতে পারিনি। দরবার স্কোয়ারের দিকে যাচ্ছি। দেখে মনে একটা সন্দেহ উঁকি দিল, আর সেটা যে ঠিক, সেটা বুঝতে পারলাম যখন পুরনো প্যালেসের সামনে খোলা জায়গাটায় এসে ফেলুদা বলল, এবার বল কোন গলিটায় গিয়েছিলি দুপুরে।
রাক্তিরে দরবার স্কোয়ারের চেহারা একেবারে অন্য রকম। এখান থেকে ওখান থেকে মন্দিরের ঘণ্টা শোনা যাচ্ছে, এরই মধ্যে কোথেকে যেন হিন্দি ফিল্মের গান ভেসে আসছে। টুরিস্টদের ভিড় আর সাইকেল-রিকশার ভিড় কাটিয়ে আমরা গলিটার মুখে গিয়ে পড়লাম। এটার নাম আগে ছিল মারু টাল, বলল ফেলুদা, হিপিরা এর নতুন নাম দিয়েছে পিগ অ্যালি–শুয়ের গলি।
পাই শপগুলোর পাশ দিয়ে আমরা এগিয়ে গেলাম। আমাদের সেই তিব্বতি দোকানটার দিকে।
দোকানটা এখনও খোলা রয়েছে। দু-একজন খদ্দেরও রয়েছে কাউন্টারের এদিকে, আর পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন সকালের সেই মহিলা। সেই পুরুষটা নেই।
ফেলুদা দোকানের বাইরে থেকেই ভেতরটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিল। দোতলা বাড়ির এক তলায় দোকানটা। দোতলায় রাস্তার দিকে দুটো পাশাপাশি জানালা, দুটোই বন্ধ। কাঠের পাল্লাগুলোর একটার ফাটলের মধ্যে দিয়ে ঘরের ভিতর একটা ক্ষীণ আলোর আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
দোকানের ডান পাশে একটা সরু চিলতে গলির পরেই একটা তিনতলা হোটেল, নাম হেভেনস গেট লাজ। স্বৰ্গদ্বার বলতে চোখের সামনে যে দৃশ্যটা ভেসে ওঠে তার সঙ্গে কোনও সাদৃশ্য নেই।
ফেলুদা হোটেলটার ভিতরে গিয়ে ঢুকল, পিছনে আমরা দুজন।
হাউ মাৰ্চ ডু ইউ চার্জ ফর রুমস হিয়ার?
কাউন্টারে একটা রোগামতন লোক বসে একটা ছোট্ট পকেট ক্যালকুলেটরের উপর পেনসিালের ডগা দিয়ে টোকা মেরে মেরে হিসেব করে একটা খাতায় লিখছে। লোকটা নেপালি কি ভারতীয় সেটা বোঝা গেল না। ফেলুদা তাকে প্রশ্নটা করেছে।
সিঙ্গল টেন, ডাবুল ফিফটিন।
কাউন্টারের সামনে খোলা জায়গাটার এক পাশে একটা খালি সোফা, তার উপরে
দেওয়ালে তিনটে পাশাপাশি টুরিস্ট পোস্টার, তিনটাতেই হিমালয়ের কোনও না কোনও বিখ্যাত শৃঙ্গের ছবি।
ঘর খালি আছে? ফেলুদা ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল।
ক’টা চাই?
একটা সিঙ্গল একটা ডাবল। দোতলার পুবদিকে হলে ভাল হয়। অবিশ্যি নেবার আগে একবার দেখে নেওয়া দরকার।
কাউন্টারের ভদ্রলোক যাকে বলে স্বল্পভাষী। মুখে কিছু না বলে শুধু একটা বেল টিপলেন, তার ফলে একটি নেপালি বেয়ারার আবির্ভাব হল। ভদ্রলোক তার হাতে একটা চাবি দিয়ে আমাদের দিকে একবার শুধু দেখিয়ে দিয়ে আবার হিসেব করতে লেগে গেলেন।
বেয়ারার পিছন পিছন সিঁড়ি উঠে আমরা সোজা চলে গেলাম পূবমুখো একটা প্যাসেজ দিয়ে। ডাইনের শেষ ঘরটা চাবি দিয়ে খুলে দিল বেয়ারা।
ঘরের বর্ণনা দেবার কোনও মানে হয় না, কারণ ফেলুদা যে ঘর ভাড়া করতে আসেনি সেটা খুব ভাল করেই জানি।
যেটা বলা দরকার সেটা এই যে, ঘরটার পুব দেয়ালে একটা জানালা রয়েছে যেটা দিয়ে তিব্বতি দোকানের দোতলার একটা জানালা এক পাশ থেকে দেখা যাচ্ছে।
লালমোহনবাবু যতক্ষণ খাটের গদি-টদি টিপে, বাথরুমের বাতি জ্বলিয়ে ভিতরটা দেখে, টেবিলের দেরাজ খোলা কি না দেখে, আমরা যে সত্যিই ঘর নিতে এসেছি—এমন একটা ধারণা বেয়ারার মনে ঢোকানোর চেষ্টা করছেন, ততক্ষণে আমি আর ফেলুদা যা দেখার দেখে নিলাম।
দোকানে দুপুরে যে তিব্বতি লোকটাকে দেখেছিলাম, সে বসে আছে ওই টিমটিমে বাতি-জ্বালা ঘরটার ভেতর। তার কাঁধ অবধি দেখা যাচ্ছে। তবে বেশ বোঝা যায়। সে কোনও একটা কাজে ব্যস্ত। তাঁর পিছনে কার্ড বার্ডের প্যাকিং কেসের স্তূপ দেখে মনে হল, সে হয় বাক্স থেকে জিনিস বার করছে না হয় বাক্সের মধ্যে পুরছে।
আরেকজন লোক রয়েছে। ঘরের ভেতর, তবে তার শুধু ছায়াটা দেখা যাচ্ছে। সে যে ঘাড় নিচু করে তিব্বতিটার কাজ দেখছে সেটা বোঝা যায়।
হঠাৎ আমার বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে উঠল।
ছায়াটা পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করেছে।
সিগারেট মুখে গোঁজার পর আরেকটা জিনিস বার করল পকেট চাপড়িয়ে।
লাইটার।
এবার লাইটারটা জ্বালানো হল।
বাঁ হাতে।
০৭. সকালে ব্রেকফাস্টের সময়
তোরা দুজন দেখবার জায়গাগুলোর কিছু আজ সকালেই দেখে নে, পরদিন সকালে ব্রেকফাস্টের সময় বলল ফেলুদা। —আমার আরেকবার থানায় যাওয়া দরকার। ট্রান্সপোর্ট তো সান ট্র্যাভেলস থেকে পেয়ে যাবি। আর কিছু না হাক, স্বয়ম্ভু, পশুপতিনাথ ও পাটনটা ঘুরে আয়। এক’দিনের পক্ষে এই তিনটেই যথেষ্ট।