আর C P নিয়ে যে ব্যাপারটা ছিল?
ওটা সহজ। সি পি হল ক্যালকাটা পুলিশ। আস্ক সি পি অ্যাবাউট মেথডস অ্যান্ড কেসেস–অর্থাৎ পুলিশকে জিজ্ঞেস করতে হবে কত রকম ভাবে ওষুধ জাল হয়, আর আগে এ রকম জালের কেস কী কী ধরা পড়েছে।
তা হলে তো খাতায় যা লেখা ছিল তার সবাই–
কলিং বেল।
আমি উঠে গিয়ে দরজা খুললাম।
যিনি ঢুকলেন, তাঁকে দেখলে বেশ হাকচাকিয়ে যেতে হয়, কারণ এত ফিটফাট ডাক্তার এর আগে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। বয়স ষাটের মধ্যে, বিলিতি পোশাকটা নিশ্চয়ই কাঠমাণ্ডুর সেরা টেলারের তৈরি, চশমার সোনার ফ্রেমটা বিলিতি, হাতের সোনার ঘড়িটা নিশ্চয়ই পেশেন্টের কাছ থেকে পাওয়া।
ফেলুদা খাটে ছিল বলে ভদ্রলোক অনুমান করে নিলেন সেই রুগী! আমি খাটের পাশে একটা চেয়ার দিয়ে দিলাম! ফেলুদা উঠে দাঁড়িয়েছিল, এখন খাটেই বসল।
কী ব্যাপার?
ভদ্রলোক বাংলা বলবেন আশা করিনি, কারণ দিবাকর পদবিটা হয়তো বাংলা নয়। তারপর মনে হল এখানকার অনেকেই তো কলকাতায় গিয়ে পড়াশুনা করেছে। ইনিও নিঘাত মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করা।
এই নিন।
ফেলুদা বালিশের তলা থেকে একটা খাম বার করে ভদ্রলোককে দিল। ডাক্তার কিঞ্চিৎ হতভম্ব।
এটা–
ওটা আপনার ফি; আর এইটে আমার কার্ড।
কার্ড মানে ফেলুদার ভিজিটিং কার্ড, যাতে নামের তলায় ওর পেশাটা লেখা আছে।
ভদ্রলোক কার্ডটার দিকে দেখতে দেখতে চেয়ারে বসলেন।
আমি জানি, আপনার কাছে ব্যাপারটা এখনও পরিষ্কার হচ্ছে না, বলল ফেলুদা, কিন্তু কয়েকটা কথা বললেই আপনি বুঝতে পারবেন।
ডাক্তারের ভাব দেখে বুঝলাম, তিনি সত্যিই এখনও অন্ধকারে রয়েছেন।
ফেলুদা বলল, প্রথমেই বলি দিই, আমি একটা খুনের তদন্ত করছি। খুনটা হয়েছে কলকাতায়, কিন্তু আমার ধারণা খুনি এখানে রয়েছে। আমি সেই ব্যাপারে কিছু তথ্য সংগ্ৰহ করছি। আমার বিশ্বাস আপনি আমাকে কিছুটা সাহায্য করতে পারেন।
খুন শুনেই ভদ্রলোকের তুরুতে ভাঁজ পড়েছে। বললেন, কে খুন হয়েছে?
সেটা পরে বলছি, বলল ফেলুদা, আগে একটা জিনিস একটু ভেরিফাই করে নিই-হরিনাথ চক্রবর্তীর ছেলেকে তো আপনি অ্যান্টি-টিট্যানাস ইনজেকশন দেন?
হ্যাঁ, আমিই।
ইনজেকশনটা বোধ করি আপনার স্টক থেকেই এসেছিল?
হ্যাঁ। আমার ডিসপেনসারির স্টক।
কিন্তু তাতে কাজ দেয়নি!
তা দেয়নি, কিন্তু তার জন্য আমাকে রেসপনসি-
আপনি ব্যস্ত হবেন না, ডঃ দিবাকর। দায়িত্বের প্রশ্ন এখনও আসছে না। ইনজেকশন দিয়েও লোকে টেট্যানাসে মরেছে এমন ঘটনা নতুন নয়। সাধারণ লোক সেটা মেনেই নেয়। হরিনাথবাবুও তাঁর ছেলের মৃত্যু মেনেই নিয়েছেন; কিন্তু ডাক্তার হয়ে, হিমাদ্রি চক্রবর্তীর মৃত্যুর কী কারণ, সে সম্বন্ধে হয়তো আপনার কোনও মতামত থাকতে পারে।
কারণ একটা নয়, বললেন ডাঃ দিবাকর, প্রথমত সে নিজেই জানত না তার ইনজুরি কখন হয়েছে। তার বন্ধু বলেছে। পনেরো-ষোল ঘণ্টা আগে। সেটা যদি ষোল না হয়ে ছাব্বিশ হয়, দেন দ্য ইনজেকশন মাইট হ্যাভ বিন টু লেট। দ্বিতীয়ত, সে ছেলে আগে কোনও কালে প্রিভেনটিভ নিয়েছে কি না সেটারও কোনও ঠিক নেই। নেওয়া থাকলে ইনজেকশনে কাজ দেবার সম্ভাবনা থাকে বেশি। ছেলে বলছে মনে নেই, বাবা বলছে নিয়েছে। হরিনাথবাবুর কথা, খুব বেশি নির্ভর করা যায় না! ওঁর স্ত্রী আর ছেলে মারা যাবার পর থেকে আমি দেখেছি ভদ্রলোকের মাঝে মাঝে মেমরি ফেল করে।
ফেলুদা বলল, হিমাদ্রির মৃত্যুর পর ওর বন্ধু কি আপনার ডিসপেনসারি থেকে কোনও ইনজেকশনের অ্যামপুল নেয়?
নিয়েছিল।
অ্যান্টি-টেট্যানাস?
হ্যাঁ।
সেটা আপনি জানলেন। কী করে? সে কি আপনার সঙ্গে দেখা করেছিল?
দেখা করেছিল বললে ঠিক বলা হবে না। সে আমার চেম্বারে ঢুকে এসে আমায় জানিয়ে দিয়ে যায় যে আমিই তার বন্ধুর মৃত্যুর জন্য দায়ী। আর সেটা যে সে খুব নরম ভাবে জানিয়েছিল তা নয়।
এই বন্ধুটিই খুন হয়েছে।
মানে?
হিমাদ্রি চক্রবর্তীর বন্ধু। অনীকেন্দ্ৰ সোম।
ডাঃ দিবাকর অবাক হয়ে চেয়ে আছেন ফেলুদার দিকে। ফেলুদা বলে চলল—
সে আপনার দোকান থেকে ওষুধ নিয়ে কলকাতা গিয়েছিল ল্যাবরেটরিতে টেস্ট করাবে বলে। সম্ভবত সে-কাজটা তার করা হয়ে ওঠেনি। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে ইনজেকশনে ভেজাল ছিল। সে চেয়েছিল যে আমার সাহায্য নিয়ে এই জাল ওষুধের চারা কারবারটা একবার তলিয়ে দেখবে।
আমার ডিসপেনসারি থেকে কোনও জাল ওষুধ বেরোয়নি, দৃঢ় স্বরে বললেন ডাঃ দিবাকর।
আপনি কি ওষুধ খাঁটি কি না পরীক্ষা করে ইনজেকশন দেন?
ভদ্রলোক রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে উঠলেন।
হাউ ইজ দ্যাট পসিবল? এমারজেন্সি কেস, তখন আমি ওষুধ পরীক্ষা করব, না ইনজেকশন দেব?
আপনার ডিসপেনসারির ওষুধ আসে কেত্থেকে?
হালসেলারদের কাছে থেকে। তাতে ব্যাচ নাম্বার থাকে, এক্সপায়ারি ডেট থাকে—
সে সবই যে জাল করা যায় সেটা আপনি জানেন? ছাপাখানার সঙ্গে বন্দোবস্ত থাকে চোরা কারবারিদের সেটা জানেন? নাম-করা বিলিতি কোম্পানির লেবেল পর্যন্ত ছাপাখানার ব্যাকডোর দিয়ে চলে যায়। এই সব জালিয়াতদের হাতে সেটা আপনি জানেন?
ডাঃ দিবাকরকে দেখে বেশ বুঝতে পারলাম যে তিনি এ কথার যুৎসই উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না।
শুনুন ডাঃ দিবাকর, ফেলুদা এবার একটু নরম সুরে বলল, আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি যে, ঘূণাক্ষরে কেউ ব্যাপারটা জানবে না। আপনি স্টক থেকে একটা অ্যান্টি-টেট্যানাসের অ্যামপুল নিয়ে তার ভেতরের পদার্থটি ল্যাবরেটরিতে টেস্ট করে তার রিপোর্ট আমাকে দিন। সময় বেশি নেই, সেটা বুঝতেই পারছেন।