সান্যালের ঘটনাটা শুনে বললেন, কোন সান্যাল বলুন তো? অহী সানাল? মাঝারি হাইট, চোখদুটো একটু বসা, থুতনিতে খাঁজ কাটা?
থুতনি তো দেখিনি ভাই। দাড়ি আছে। বোধহয় আগে রাখতেন না।
আমি দু বছর আগের কথা বলছি। একই লোক কি না জানি না। বাম্বেতে ছিল কিছু দিন। ছবিও প্রোডিউস করেছিল খান দু-এক! মার খেয়েছিল—যদ্দূর মনে পড়ে।
লোক কী রকম?
সে খবর জানি না লালুদা, তবে বদনাম শুনিনি কখনও।
তা হলে বোধহয় কাগজের প্যাকেটে কোনও গোলমাল নেই।
দেখুন লালুদা, আজকাল নেহাত স্মাগলিং-টাগলিং হচ্ছে বলে, নইলে আমরাও তো এককালে অনেক অচেনা লোকের হাত থেকে জিনিস নিয়ে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় পৌঁছে দিয়েছি। কই, কোনওদিন তো কোনও গোলমাল হয়নি।
যে গাড়িটা কাল ব্যবহার করেছিলাম, সেটাতেই আমরা চারজনে মহালক্ষ্মীর ফেমাস স্টুডিয়োতে গিয়ে হাজির হলাম। গাড়ি থেকে নামবার সময় পুলকবাবু বললেন, আগামী কালের শুটিং-এ ট্রেনের ব্যাপারটায় রেল কোম্পানির লোকদের সঙ্গে ঠোকাঠুকি হচ্ছিল। খবরটা পেয়েই প্রোডিউসার রাত্তিরের প্লেন ধরে কলকাতা থেকে চলে এসেছেন। চলুন, আপনাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিচ্ছি।
কালকের শুটিংটা হবে তো? লালমোহনবাবুর গলায় আশঙ্কার সুর।
শুটিং-এর ফাদার হবে লালুদা, ঘাবড়াইয়ে মৎ।
আমরা একটা টিনের ছাতওয়ালা কারখানার ঘরের মতো বিরাট ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। এখানেই শুটিং হয়, আর আজ এখানেই চলেছে কুং-ফুর ট্রেনিং। একটা প্রকাণ্ড গদির উপর ভিক্টর পেরুমলের নির্দেশে একদল লোক লাফাচ্ছে, পা ছুড়ছে, আছািড় খাচ্ছে। গদি থেকে হাত দশেক দূরে একটা বেতের চেয়ারে বসে আছেন একজন বছর পয়তাল্লিশের ভদ্রলোক।
আলাপ করিয়ে দিই, বললেন পুলকবাবু, ইনি হচ্ছেন আমাদের ছবির প্রযোজক মিঃ গোরে…মিস্টার গাঙ্গুলী, স্টেরি রাইটার-মিস্টার মিত্র, আর-—তোমার নামটা কী ভাই?
তপেশরঞ্জন মিত্র।
মিঃ গোরের গাল দুটো আপেলের মতো, মাথার ঠিক মাঝখানে একটা চকচকে টাক, আর চোখদুটো সামান্য কটা। তুড়িটা নিশ্চয়ই। ইদানীং হয়েছে, কারণ শখ করে এত টাইট জামা কেউ পরে না। পুলকবাবু আলাপ করিয়ে দিয়ে হাওয়া, কারণ কালকের শুটিং-এর নাকি অনেক তোড়জোড় আছে। বলে গেলেন, দেড়টায় ফিরছি লালুদ; আমার সঙ্গে লাঞ্চ খাচ্ছেন। আপনারা।
গোরে আমাদের খুব খাতির-টাতির করে চেয়ার আনিয়ে বসতে দিলেন। নিজে লালমোহনবাবুর পাশে বসে বললেন, আপনি এলেন বলে আমি খুব খুশি হলাম।
সে কী, আপনি তো দিব্যি বাংলা বলেন!
লালমোহনবাবু বোধহয় তাঁর দশ হাজার পাওনার কথাটা ভেবেই একটু বেশি খুলে তারিফ করলেন।
আমার ফাদারের বিজনেস ছিল ক্যানিং স্ট্রিটে। থ্রি ইয়ারস আই ওয়জ এ স্টুডেন্ট ইন ডন বস্কো। দেন ফাদারের ডেথ হল, আমি আস্কেলের কাছে চলে এলাম বুম্বই। সে তখুন থেকেই আই অ্যাম হিয়ার। লেকিন ফিলিম লাইনে দিস ইজ মাই ফাস্ট ভেনচার।
গোরে বাংলা জানেন দেখেই বোধহয় লালমোহনবাবু বেশ উৎসাহের সঙ্গে সান্যাল থেকে শুরু করে আজকের পুলিশের জেরা অবধি সব ঘটনা ভদ্রলোককে বলে ফেললেন। তাতে মিঃ গোরে চুকচুক শব্দ করে সহানুভূতি জানিয়ে বললেন, আজকাল কাউকে বিসোয়াস করা যায় না, মিস্টার গাঙ্গুলী। আপনি এমিনেন্ট রাইটার, আপনার হাতে চারাই মাল পাচার হবে ভাবতে শরুম লাগে।
এবার ফেলুদাও যোগ দিল কথায়।
আপনি তো শিবাজী কাসূলে থাকেন বলে শুনলাম!
হাঁ। দুমাস হল আছি। হরিবল মাডার। ইভনিং ফ্লাইটে এসেছি আমি। বাড়ি ফিরেছি রাত ইগারটা। অ্যাট দ্যাট টাইম অলসো দেয়ার ওয়জ এ বিগ ক্রাউড ইন দ্য স্ট্রিট। হাই-রাইজ বিল্ডিংমৌ খুনখারাবি হানেসে বহুং হুজ্জৎ।
ইয়ে-সেভেনটিনথ ফ্লোরে কে থাকে জানেন?
সেভেনটিন থা…সেভেনটিনখ. ভদ্রলোক মনে করতে পারলেন না। আমার চিনা আদমি এক হ্যাঁয়। এইটুথ মে—এন সি মেহতা; আমাউর দো মে ডক্টর স্তাজিফদার। মাই ফ্ল্যাট ইজ অন টুয়েলফথ ফ্লোর।
ফেলুদা আর কোনও প্রশ্ন করল না। মিঃ গোরেরও দেখলাম উঠি-উঠি ভাব। বললেন বহুৎ ঝামেলার প্রোডাকশন, সব সময় কিছু না কিছু কাজ লেগেই থাকে। তা ছাড়া কালকের শুটিংটা সত্যিই এলাহি ব্যাপার। মাথেরান স্টেশন থেকে ভাড়া করা ট্রেন খাণ্ডাল আর লোনাউলির মাঝামাঝি লেভেল ক্রসিং-এ আসবে। মিঃ গোরে মাথোরানেই থাকবেন, কারণ রেল কোম্পানিকে পয়সাকড়ি দেওয়ার ব্যাপার আছে! একটা পুরনো আমলের ফাস্ট-ক্লাস কামরা থাকবে ট্রেনে, মিঃ গোরে সেই কামরায় চেপেই শুটিং-এর জায়গায় আসবেন। আমি খুব খুশি হব। যদি আপনারা আমার সঙ্গে এসে লাঞ্চ করেন। আপনারা ভেজিটেরিয়ান কি?
নো নো, নন নন, বললেন লালমোহনবাবু।
হোয়াট উইল ইউ হ্যাভ? চিকেন আর মটন?
চিকেন হ্যাঁড ইয়েসটারডে। মাটনই হোক টুমরো; কী বলেন, ফেলুবাবু?
তথাস্তু, বলল ফেলুদা।
ফেলুদা মিস্টার গোরের সব কথাই শুনছিল, কিন্তু তারই ফাঁকে ফাঁকে ওর চোখটা যে বারবার কুং-ফুর দিকে চলে যাচ্ছিল, সেটা আমি লক্ষ করছিলাম। ভিক্টর পেরুমলের ধৈর্য আর অধ্যবসায় দেখে সত্যিই অবাক হতে হয়। বোঝাই যাচ্ছে, ব্যাপারটাকে নিখুঁত না করে সে ছাড়বে না। যারা শিখছে, তাদের মধ্যে দু-একজন দেখলাম। রীতিমতো তৈরি হয়ে গেছে।
পেরুমালকেও দেখছিলাম কাজের ফাঁকে ফাঁকে ফেলুদার দিকে দেখছে। ফেলুদার চাহনিতে তারিফের ভাবটা বোধহয় তাকে উৎসাহিত করছিল। গোরে চলে যাবার পর পেরুমাল ফেলুদাকে ইশারা করে কাছে আসতে বলল। ফেলুদা হাতের সিগারেটটা ফেলে দিয়ে উঠে এগিয়ে গেল।