- বইয়ের নামঃ বাদশাহী আংটি
- লেখকের নামঃ সত্যজিৎ রায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, ফেলুদা সমগ্র
০১. বাদশাহী আংটি
বাবা যখন বললেন, তোর ধীরুকাকু অনেকদিন থেকে বলছেন—তাই ভাবছি এবার পুজোর ছুটিটা লখ্নৌতেই কাটিয়ে আসি—তখন আমার মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আমার বিশ্বাস ছিল লখ্নৌটা বেশ বাজে জায়গা। অবিশ্যি বাবা বলেছিলেন ওখান থেকে আমরা হরিদ্বার লছমনঝুলাও ঘুরে আসব, আর লছমনঝুলাতে পাহাড়ও আছে—কিন্তু সে আর কদিনের জন্য? এর আগে প্রত্যেক ছুটিতে দার্জিলিং না হয় পুরী গিয়েছি; আমার পাহাড়ও ভাল লাগে, আবার সমুদ্রও ভাল লাগে। লখ্নৌতে দুটোর একটাও নেই। তাই বাবাকে বললাম, ফেলুদা যেতে পারে না আমাদের সঙ্গে?
ফেলুদা বলে ও কলকাতা ছেড়ে যেখানেই যাক না কেন, ওকে ঘিরে নাকি রহস্যজনক ঘটনা সব গজিয়ে ওঠে। আর সত্যিই, দার্জিলিং-এ যেবার ও আমাদের সঙ্গে ছিল, ঠিক সেবারই রাজেনবাবুকে জড়িয়ে সেই অদ্ভুত ঘটনাগুলো ঘটল। তেমন যদি হয় তা হলে জায়গা ভাল না হলেও খুব ক্ষতি নেই।
বাবা বললেন, ফেলু তো আসতেই পারে, কিন্তু ও যে নতুন চাকরি নিয়েছে, ছুটি পাবে কি?
ফেলুদাকে লখ্নৌয়ের কথা বলতেই ও বলল, ফিফ্টি-এইটে গেস্লাম-–ক্রিকেট খেলতে। জায়গাটা নেহাত ফেলনা নয়। বড়াইমামবড়ার ভুলভুলাইয়ার ভেতরে যদি ঢুকিস তো তোর চোখ আর মন একসঙ্গে ধাঁধিয়ে যাবে। নবাব-বাদশাহের কী ইম্যাজিনেশন ছিল-বাপরে বাপ!
তুমি ছুটি পাবে তো?
ফেলুদা আমার কথায় কান না দিয়ে বলল, আর শুধু ভুলভুলাইয়া কেন—গুমতী নদীর ওপর মাঙ্কি ব্রিজ দেখবি, সেপাইদের কামানের গোলায় বিধ্বস্ত রেসিডেন্সি দেখবি।
রেসিডেন্সি আবার কী?
সেপাই বিদ্রোহের সময় গোরা সৈনিকদের ঘাঁটি ছিল ওটা। কিসু করতে পারেনি। ঘেরাও করে গোলা দেগে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল সেপাইরা?
দুবছর হল চাকরি নিয়েছে ফেলুদা, কিন্তু প্রথম বছর কোনও ছুটি নেয়নি বলে পনেরো দিনের ছুটি পেতে ওর কোনও অসুবিধে হল না।
এখানে বলে রাখি—ফেলুদা আমার মাসতুতো দাদা। আমার বয়স চোদ্দো, আর ওর সাতাশ। ওকে কেউ কেউ বলে আধপাগলা, কেউ কেউ বলে খামখেয়ালি, আবার কেউ কেউ বলে কুঁড়ে। আমি কিন্তু জানি ওই বয়সে ফেলুদার মতো বুদ্ধি খুব কম লোকের হয়। আর ওর মনের মতো কাজ পেলে ওর মতো খাটতে খুব কম লোকে পারে। তা ছাড়া ও ভাল ক্রিকেট জানে, প্রায় একশ্বে রকম ইনডোর গেম বা ঘরে বসে খেলা জানে, তাসের ম্যাজিক জানে, একটু একটু হিপূনটিজম জানে, ডান হাত আর বা হাত দুহাতেই লিখতে জানে। আর ও যখন স্কুলে পড়ত তখনই ওর মেমরি এত ভাল ছিল যে ও দুবার রিডিং পড়েই পুরো ‘দেবতার গ্রাস’ মুখস্থ করেছিল।
কিন্তু ফেলুদার যেটা সবচেয়ে আশ্চর্য ক্ষমতা, সেটি হল—ও বিলিতি বই পড়ে আর নিজের বুদ্ধিতে দারুণ ডিটেক্টিভের কাজ শিখে নিয়েছে। তার মানে অবশ্যি এই নয় যে চোর ডাকাত খুনি এইসব ধরার জন্য পুলিশ ফেলুদাকে ডাকে। ও হল যাকে বলে শখের ডিটেকটিভ।
সেটা বোঝা যায় যখন একজন অচেনা লোককে একবার দেখেই ফেলুদা তার সম্বন্ধে অনেক কিছু বলে দিতে পারে।
যেমন লখ্নৌ স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে ধীরুকাকাকে দেখেই ও আমায় ফিসফিস করে বলল, তোর কাকার বুঝি বাগানের শখ?
আমি যদিও জানতাম ধীরুকাকার বাগানের কথা, ফেলুদার কিন্তু মোটেই জানার কথা নয়, কারণ, যদিও ফেলুদা আমার মাসতুতো ভাই, ধীরুকাকা কিন্তু আমার আসল কাক নন, বাবার ছেলেবেলার বন্ধু।
তাই আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কী করে জানলে?
ফেলুদা আবার ফিসফিস করে বলল, উনি পিছন ফিরলে দেখবি ওঁর ডান পায়ের জুতোর গোড়ালির পাশ দিয়ে একটা গোলাপ পাতার ডগা বেরিয়ে আছে। আর ডান হাতের তর্জনীটায় দেখ টিনচার আয়োডিন লাগানো। সকালে বাগানে গিয়ে গোলাপ ফুল ঘাঁটার ফল।
স্টেশন থেকে বাড়ি আসার পথে বুঝলাম লখ্নৌ শহরটা আসলে খুব সুন্দর। গম্বুজ আর মিনারওয়ালা বাড়ি দেখা যাচ্ছে চারদিকে, রাস্তাগুলো চওড়া আর পরিষ্কার, আর তাতে মোটরগাড়ি ছাড়াও দুটো নতুন রকমের ঘোড়ার গাড়ি চলতে দেখলাম। তার একটার নাম টাঙ্গা আর অন্যটা এক্কা। এক্কা গাড়ি খুব ছুটেছে—এই জিনিসটা নিজের চোখে এই প্রথম দেখলাম। ধীরুকাকার পুরনো সেভ্রোলে গাড়ি না থাকলে আমাদের হয়তে ওরই একটাতে চড়তে হত।
যেতে যেতে ধীরুকাক বললেন, এখানে না এলে কি বুঝতে পারতে শহরটা এত সুন্দর? আর কলকাতার মতো আবর্জনা কি দেখতে পাচ্ছ রাস্তাঘাটে? আর কত গাছ দেখো, আর কত ফুলের বাগান।
বাবা আর ধীরুকাক পিছনে বসেছিলেন, ফেলুদা আর আমি সামনে। আমার পাশেই বসে গাড়ি চালাচ্ছে ধীরুকাকার ড্রাইভার দীনদয়াল সিং। ফেলুদা আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, ভুলভুলাইয়ার কথাটা জিজ্ঞেস কর।
ফেলুদা কিছু করতে বললে সেট না করে পারি না। তাই বললাম, আচ্ছ ধীরুকাকা, ভুলভুলাইয়া কী জিনিস?
ধীরুকাকা বললেন, দেখবে দেখবে—সব দেখবে। ভুলভুলাইয়া হল ইমামবড়ার ভেতরে একটা গোলকধাঁধা। আমরা বাঙালিরা অবিশ্যি বলি ঘুলঘুলিয়া; কিন্তু আসল নাম ওই ভুলভুলাইয়া। নবাবরা তাঁদের বেগমদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতেন ওই গোলকধাঁধায়।
এবার ফেলুদা নিজেই বলল, ওর ভেতরে গাইড ছাড়া ঢুকলে নাকি আর বেরোনো যায় না?