আপনিও তা হলে অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পাচ্ছেন, ফেলুবাবু?
ফেলুদা সরাসরি উত্তর না দিয়ে একটা পালটা প্রশ্ন করল।
লোকটা আপনার হাত থেকে বইটা নিয়ে কী করল, সেটা লক্ষ করেছিলেন?
কেন?–চলে গেল! বললেন লালমোহনবাবু।
ওই তো! কেবল মোটা জিনিসটাই দেখেছেন, সূক্ষ্ম জিনিসটা চোখে পড়েনি। লোকটা খানিক দূর গিয়েই পকেট থেকে খুচরো পয়সা বার করেছিল।
টেলিফোন। আমি বলে উঠলাম।
ভেরি গুড, তোপ্সে। আমার বিশ্বাস লোকটা এয়ারপোর্টের পাবলিক টেলিফোন থেকে শহরে ফোন করে। তারপর আমরা যখন আমাদের মালের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তখন লোকটাকে আবার দেখতে পাই।
কোথায়?
আমরা যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, তার ঠিক বাইরেই প্রাইভেট গাড়ি দাঁড়বার জায়গা। মনে পড়ছে।
হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি বলে উঠলাম। লালমোহনবাবু চুপ।
লোকটা একটা নীল অ্যাম্বাসাডারে ওঠে। ড্রাইভার ছিল। পাঁচ-সাত মিনিট চেষ্টা করেও গাড়ি স্টার্ট নেয় না। লোকটা গাড়ি থেকে নেমে এসে ড্রাইভারের উপর তম্বি করে। কথা না শুনলেও, ভাবভঙ্গিতে সেটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল। তারপর লোকটা গাড়ির আশা ছেড়ে চলে যায়।
ট্যাক্সি নিতে —এবার লালমোহনবাবু।
এগজাক্টলি-তাতে কী বোঝা যায়?
লোকটা ব্যস্ত-ইয়ে, ব্যতিব্যস্ত-ইয়ে, মানে, লোকটার তাড়া ছিল।
গুড। দৃষ্টি আর মস্তিষ্ক—এই দুটোকে সজাগ রাখলে অনেক কিছুই অনুমান করা যায়, লালমোহনবাবু। কাজেই আমি যে ট্যাক্সিটাকে ফলো করেছিলাম তাঁর পিছনে একটা কারণ ছিল।
কী মনে হচ্ছে বলুন তো আপনার? লালমোহনবাবু সোজা হয়ে বসে কনুই দুটো টেবিলের উপর রেখে প্রশ্নটা করলেন।
এখনও কিছুই মনে হচ্ছে না, বলল ফেলুদা, শুধু একটা খটকা।
এর পরে আমরা এ ব্যাপারটা নিয়ে আর কোনও কথা বলিনি।
পাঁচটা নাগাত বিশ্রাম-টিশ্রাম করে লালমোহনবাবু আমাদের ঘরে এলেন। তিনজনে বসে চা আনিয়ে খাচ্ছি, এমন সময় দরজায় টাকা। যিনি ঢুকলেন তার বয়স পঁয়ত্ৰিশের বেশি। কিছুতেই নয়, কিন্তু মাথা ভরতি ঢেউ খেলানো চুলে আশ্চর্য বেশি রকম পাক ধরে গেছে।
এই যে লালুদা—কেমন, এভরিথিং অলরাইট?
লালুদা!–লালমোহনবাবুকে যে কেউ লালুদা ডাকতে পারে সেটা কেন জানি মাথাতেই আসেনি। বুঝলাম-ইনিই হচ্ছেন পুলক ঘোষাল। ফেলুদা আগেই লালমোহনবাবুকে শাসিয়ে রেখেছিল যে, ওর আসল পরিচয়টা যেন চেপে রাখা হয়। তাই পুলকবাবুর কাছে ও হয়ে গেল। লালমোহনবাবুর বন্ধু। পুলকবাবু আক্ষেপের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললেন, দেখুন তো, আপনি লালুদার বন্ধু, এত কাছের মানুষ, আর আমরা হিরোর অভাবে হিমসিম খাচ্ছি। আপনার হিন্দি আসে?
ফেলুদা একটা খোলা হাসি হেসে বলল, হিন্দি তো আসেই না, অভিনয়টা আরওই আসে না। কিন্তু হিরোর অভাব কী রকম? আপনাদের তো শুটিং আরম্ভ হয়ে যাচ্ছে শুনলাম। অর্জুন মেরহোত্রা করছে না?
তা তো করছে, কিন্তু অর্জুন কি আর সে-অর্জুন আছে? এখন তার হাজার বায়নাক্কা। এদের আমি হিরো বলি না মশাই। আসলে এরা চোরা ভিলেন, পদায় যাই হন না কেন। নাই দিয়ে দিয়ে এদের মাথাটি খেয়ে ফেলেছে। এখানকার প্রোডিউসাররা। —যাক গে, পরশু আপনাদের ইনভাইট করে যাচ্ছি। এখান থেকে মাইল সত্তর দূরে শুটিং ৭ ড্রাইভার জায়গা চেনে। সঙ্কাল সঙ্কল বেরিয়ে সোজা চলে আসবেন। মিস্টার গোরে-মানে আমার প্রোডিউসার—এখানে, নেই; ছবি বিক্রির ব্যাপারে দিন সাতেকের জন্য দিল্লি মাদ্রাজ কলকাতা ঘুরতে গেছেন। তবে উনি বলে গেছেন আপনাদের আতিথেয়তার যেন কোনও ত্রুটি না হয়।
কোথায় শুটিং? ফেলুদা প্রশ্ন করল।
বিটউইন খাণ্ডালা অ্যান্ড লোনাউলি। ট্রেনের সিন। প্যাসেঞ্জারের অভাব হলে আপনাদের বসিয়ে দেব কিন্তু।
ভাল কথা, লালমোহনবাবু বললেন, আমরা শিবাজী কাসল দেখে এলুম।
কথাটা শুনে পুলকবাবুর ভুরু কুঁচকে গেল।
সেকী, কখন?
এই তো, আসার পথে। ধরুন, এই দুটো নাগাদ।
ও। তা হলে ব্যাপারটা আরও পরে হয়েছে।
কী ব্যাপার মশাই?
খুন।
সে কী।—আমরা তিনজনে প্রায় একসঙ্গে বলে উঠলাম। খ-য়ে হ্রস্বউ আর ন—এই দুটো পর পর জুড়লে আপনা থেকেই যেন শিউরে উঠতে হয়।
আমি খবর পাই এই আধঘণ্টা আগে, বললেন পুলকবাবু।ও বাড়িতে তো আমার রেগুলার যাতায়াত মশাই! মিস্টার গোরেও শিবাজী কাসলেই থাকেন—বারো নম্বর ফ্লোরে। সাধে কি আপনার গপ্লে বাড়ির নাম চেঞ্জ করতে হয়েছে। অবিশ্যি উনি নিজে খুব মাই-ডিয়ার লোক। –আপনারা বাড়ির ভেতরে গেসলেন নাকি?
আমি গিয়েছিলাম, বলল ফেলুদা, লিফটের দরজা অবধি।
ওরেব্বাবা! লিফটের ভেতরেই তো খুন। লাশ সনাক্ত হয়নি এখনও। দেখতে গুণ্ডা টাইপ। তিনটে নাগাত ত্যাগরাজন বলে ওখানকারই এক বাসিন্দা তিন তলা থেকে লিফটের জন্য বেল টেপে। লিফুট ওপর থেকে নীচে নেমে আসে। ভদ্রলোক দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে গিয়েই দেখেন এই কাণ্ড। পেটে ছোরা মেরেছে মশাই। হরিবল ব্যাপার।
ওই সময়টায় লিফটে কাউকে উঠতে-টুঠতে দেখেনি। কেউ? প্রশ্ন করল ফেলুদা।
লিফটের আশেপাশে কেউ ছিল না। তবে বিল্ডিং-এর বাইরে দুজন ড্রাইভার ছিল, তারা ওই সময়টায় পাঁচ-ছজনকে ঢুকতে দেখেছে। তার মধ্যে একজনের গায়ে লাল শার্ট, একজনের কাঁধে ব্যাগ আর গায়ে খয়েরি রঙের-
ফেলুদা হাত তুলে পুলকবাবুকে থামিয়ে বলল, ওই দ্বিতীয় ব্যক্তিটি স্বয়ং আমি, কাজেই আর বেশি বলার দরকার নেই।
আমার বুকের ভিতরটা ধড়াস করে উঠেছে। সর্বনাশ!—ফেলুদা কি খুনের মামলায় জড়িয়ে পড়বে নাকি?