ফেলুদা অবিশ্যি এখানে আসবার আগে ওর অভ্যাস মতো বম্বে সম্বন্ধে পড়াশুনা করে নিয়েছে! ও বলে, কোনও নতুন জায়গায় আসার আগে এ জিনিসটা করে না নিলে নাকি সে জায়গা দূরেই থেকে যায়। মানুষের যেমন একটা পরিচয় তার নামে, একটা চেহারায়, একটা চরিত্রে আর একটা তার অতীত ইতিহাসে, ঠিক তেমনই নাকি শহরেরও। বম্বে শহরের চেহারা আর চরিত্র এখনও ফেলুদার জানা নেই, তবে এটা জানে যে শালিমার হোটেল হল কেম্পস কর্নারের কাছে।
আমাদের গাড়ি হাইওয়ে দিয়ে গিয়ে একটা বড় রাস্তায় পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফেলুদা ড্রাইভারকে উদ্দেশ করে বলল-উয়ো যে ট্যাক্সি হ্যাঁয় না–এম আর পি গ্রি ফাইভ খ্রি এইট-উসকো পিছে পিছে চলনা।
কী ব্যাপার মশাই? লালমোহনবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
একটা সামান্য কৌতুহলী, বলল ফেলুদা।
আমাদের গাড়ি একটা স্কুটার আর দুটো অ্যাম্বাসাডরকে ছাড়িয়ে ফিয়াট ট্যাক্সিটার ঠিক পিছনে এসে পড়ল। এবার ট্যাক্সিটার পিছনের কাচ দিয়ে দেখলাম ভিতরে বাসা লাল টেরিলিনের শার্ট।
একটু যেন বুকটা কেঁপে উঠল। কিছুই হয়নি, কেন ফেলুদা ট্যাক্সিটাকে ধাওয়া করছে তাও জানি না, তবু ব্যাপারটা আমার হিসেবের বাইরে বলেই যেন একটা রহস্য আর অ্যাডভেঞ্চারের ছোঁয়া লাগল। লালমোহনবাবু অবিশ্যি আজকাল ধরেই নিয়েছেন যে, ফেলুদার সব কাজের মানে জিজ্ঞেস করে সব সময়ে সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে না; যথাসময়ে আপনা থেকেই সেটা জানা যাবে।
আমাদের গাড়ি দিব্যি ট্যাক্সিটাকে চোখে রেখে চলেছে, আমরাও নতুন শহরের রাস্তাঘাট লোকজন দেখতে দেখতে চলেছি। একটা জিনিস বলতেই হবে।–হিন্দি ছবির এত বেশি। আর এত বড় বড় বিজ্ঞাপন আর কোনও শহরের রাস্তায় দেখিনি। লালমোহনবাবু কিছুক্ষণ ধরে ঘাড় ফিরিয়ে ফিরিয়ে সেগুলো দেখে বললেন, সবাইয়ের নামই তো দেখছি, অথচ কাহিনীকারের নামটা কেন চোখে পড়ছে না। এরা কি গল্প লেখায় না কাউকে দিয়ে?
ফেলুদা বলল, গল্প লেখক হিসেবে নাম যদি আশা করেন, তা হলে বম্বে আপনার জায়গা নয়। এখানে গল্প লেখা হয় না, গল্প তৈরি হয়, ম্যানুফ্যাকচার হয়–যেমন বাজারের আর পাঁচটা জিনিস ম্যানুফাকচার হয়। লাক্স সাবান কে তৈরি করেছে, তার নাম কি কেউ জানে?—কোম্পানির নামটা হয়তো জানে। টাকা পাচ্ছেন, ব্যস; মুখটি বন্ধ করে বসে থাকুন। সম্মানের কথা তুলে যান।
হুঁ…। লালমোহনবাবু বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তা হলে মান হল গিয়ে আপনার বেঙ্গলে, আর বম্বেতে হচ্ছে মানি।
হক কথা, বলল ফেলুদা।
ফেলুদা যে-এলাকাটাকে মহালক্ষ্মী বলে বলল, সেটা ছাড়িয়ে কিছু দূর গিয়ে আমাদের মাকামারা ট্যাক্সিটা একটা ভান দিকের রাস্তা ধরল। আমাদের ড্রাইভার বলল যে, শালিমার হোটেল যেতে হলে আমাদের সোজাই যাওয়া উচিত।
ফেলুদা বলল, আপ দাঁয়া চলিয়ে।
ডান দিকে ঘুরে মিনিট দু-এক যেতেই দেখলাম ট্যাক্সিটা বা দিকে একটা গেটের ভিতর ঢুকে গেল! ফেলুদার নির্দেশে আমাদের গাড়ি গেটের বাইরেই থামল। আমরা তিনজনেই গাড়ি থেকে নামালাম, আর নামার সঙ্গে সঙ্গেই লালমোহনবাবু হিক করে একটা অদ্ভুত শব্দ <दू।8न्!
কারণটা পরিষ্কার। আমরা একটা বিরাট ঢাঙা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছি, তার তিনতলার হাইটে বড় বড় উঁচু উঁচু কালো অক্ষরে ইংরাজিতে লেখা–শিবাজী কাস্ল।
০৩. নামটা দেখে অবাক লাগল
নামটা দেখে আমার এত অবাক লাগল যে, কিছুক্ষণ কোনও কথাই বলতে পারলাম না। এ যে টেলিপ্যাথির ঠাকুরদাদা —বললেন লালমোহনবাবু।
ফেলুদা চুপ। দেখলাম ও শুধু বাড়িটাই দেখছে না, তার আশপাশটাও দেখছে। বাঁদিকে পর পর অনেকগুলো বাড়ি, তার কোনওটাই বিশ তলার কম না। ডান দিকের বাড়িগুলো নিচু আর পুরনো, আর সেগুলোর ফাঁক দিয়ে পিছনে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে।
ড্রাইভার একটু যেন অবাক হয়েই আমাদের হাবভাব লক্ষ করছিল। ফেলুদা তাকে অপেক্ষা করতে বলে সোজা গেটের ভিতর দিয়ে ঢুকে গেল। আমি আর লালমোহনবাবু বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম।
মিনিট তিনেক পরেই ফেলুদা বেরিয়ে এল।
চলিয়ে শালিমার হোটেল।
আমরা আবার রওনা দিলাম। ফেলুদা একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, খুব সম্ভবত সেভেনটিন্থ ফ্রোরে, অর্থাৎ আঠারো তলায় গেছে আপনার বইয়ের প্যাকেট।
আপনি যে ভেলকি দেখালেন মশাই, বললেন লালমোহনবাবু, এই তিন মিনিটের মধ্যে অত বড় বাড়ির কোন তলায় গেছে লোকটা, সেটা জেনে ফেলে দিলেন?
আঠারোতলায় গেছে কি না জানিবার জন্য আঠারোতলায় ওঠার দরকার হয় না। এক তলার লিফটের মাথার উপরেই বার্ডে নম্বর লেখা থাকে। যখন পৌঁছলাম, তখন লিফট উঠতে শুরু করে দিয়েছে। শেষ যে নম্বরটার বাতি জ্বলে উঠল, সেটা হল সতেরো। এবার বুঝেছেন তো?
লালমোহনবাবু দীৰ্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, বুঝলুম তো। এত সহজ ব্যাপারটা আমাদের মাথায় কেন আসে না সেটাই তো বুঝি না।
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই শালিমার হোটেলে পৌঁছে গেলাম। ফেলুদা আর আমার জন্য পাঁচ তলায় একটা ডাবল রুম, আর লালমোহনবাবুর জন্য ওই একই তলায় আমাদের উলটা দিকে একটা সিঙ্গল। আমাদের ঘরটা রাস্তার দিকে, জানালা দিয়ে নীচে চাইলেই অবিরাম গাড়ির স্রোত, আর সামনের দিকে চাইলে দুটো ঢাঙা বাড়ির ফাঁক দিয়ে দূরে সমুদ্র। বম্বে যে একটা গমগমে শহর, সেটা এই ঘরে বসেই বেশ বোঝা যায়। খিদে পেয়েছিল প্রচণ্ড; হাত-মুখ ধুয়ে তিনজনে গেলাম হাটেলেরই দাতলায় গুলমার্গ রেস্টোর্যান্টে। লালমোহনবাবুর ঠোঁটের ডগায় যে প্রশ্নটা এসে আটকে ছিল, সেটা খাবারের অর্ডার দিয়েই করে ফেললেন।