ভদ্রলোক বাঙালি?
ইয়েস স্যার। বারেন্দ্র। সানাল! কথায় পশ্চিমা টান আছে। বললেন জব্বলপুরের মানুষ। গায়ে উগ্র পারফিউমের গন্ধ। নাক জ্বলে যায় মশাই। পুরুষ মানুষ এভাবে সেন্ট মাখে এই প্রথম এক্সপেরিয়েন্স করলুম। যাই হাক, আমি চলে যাচ্ছি শুনে একটা ঠিকানা দিয়ে দিলেন। বললেন, কোনও অসুবিধে হলে একে ফোন করতে পারেন। আমার এ বন্ধুটি খুব হেলপ্ফুল।
কলকাতায় ডিসেম্বরে বেশ শীত পড়লেও বম্বেতে নাকি তেমন ঠাণ্ডা পড়ে না। আমাদের ছোট দুটো সুটকে সেই সব ম্যানেজ হয়ে গেল! মঙ্গলবার সকালে উঠে দেখি কুয়াশায় রাস্তার ও পারে পলুটুদের বাড়িটা পর্যন্ত ভাল করে দেখা যাচ্ছে না। প্লেন ছাড়বে তো? আশ্চর্য নটার মধ্যে সব সাফ হয়ে গিয়ে ঝকঝকে রোদ উঠে গেল। ভি আই পি রোডে এমনিতেই শহরের চেয়ে বেশি কুয়াশা হয়, কিন্তু আজ দেখলাম তেমন কিছু নয়।
এয়ারপোর্টে যখন পৌঁছলাম, তখন প্লেন ছাড়তে পঞ্চাশ মিনিট বাকি। লালমোহনবাবু আগেই হাজির। এমনকী বোর্ডিং কার্ডও দেখলাম উঁকি মারছে পকেট থেকে। বললেন, কিছু মনে করবেন না, ফেলুবাবু-লম্বা কিউ দেখে ভাবলুম যদি জানলার ধারে সিট না পাই, তাই আগেভাগেই সেরে রাখলুম। এইচ রো-দেখুন হয়তো দেখবেন কাছাকাছি সিট পেয়ে গেছেন।
আপনার হাতে ওষ্টা কী? কী বই কিনলেন?
লালমোহনবাবুর বগলে একটা ব্ৰাউন কাগজের প্যাকেট দেখে আমার মনে হয়েছিল। উনি নিজের বই সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন। ওখানে কাউকে দেবেন বলে।
ফেলুদার প্রশ্নের জবাবে ভদ্রলোক বললেন, কিনব কি মশাই; সেই সান্যাল-সে দিন যার কথা বলেছিলাম—সে দিয়ে গেল। এই মিনিট দশেক আগে।
উপহার
নো স্যার। বম্বে এয়ারপোটে লোক এসে নিয়ে যাবে। আমার নাম-ধাম তাকে জানিয়ে দিয়েছেন। কোন এক আত্নীয়ের কাছে যাবে এ বই। তারপর একটু হেসে বললেন, ইয়ে–<একটা বেশ অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পাচ্ছেন না?
পাওয়া মুশকিল, বলল ফেলুদা, কারণ ভারত কেমিক্যালস-এর গুলবাহার সেন্টের গন্ধ আর সব গন্ধকে স্নান করে দিয়েছে।
গন্ধটা আমিও পেয়েছিলাম। সান্যাল মশাই এমনই সেন্ট মাখেন যে তার সুবাস এই প্যাকেটে পর্যন্ত লেগে রয়েছে।
যা বলেছেন স্যার, হাঃ হাঃ, সায় দিলেন জটায়ু। তবে অনেক সময় শুনিচি, এইভ লোকে উলটাপালটা জিনিসও চালান দেয়।
সে তো বটেই। বুকিং কাউন্টারে তো নোটিসই লাগানো আছে যে, অচেনা লোকের হাত থেকে চালান দেওয়ার জন্য কোনও জিনিস নেওয়াটা বিপজ্জনক। অবিশি; এ ভদ্রলোককে টেকনিক্যালি ঠিক অচেনা বলা চলে না, আর প্যাকেটটাও যে বইয়ের, সেটা সন্দেহ করার কোনও কারণ দেখছি না।
প্লেনে তিনজনে পাশাপাশি জায়গা পেলাম না; লালমোহনবাবু আমাদের তিনটে সারি পিছনে জানলার ধারে বসলেন। ফ্লাইটে বলবার মতো তেমন কিছু ঘটেনি। কেবল লাউডস্পিকারে ক্যাপ্টেন দত্ত যখন বলছেন আমরা নাগপুরের উপর দিয়ে যাচ্ছি, তখন পিছন ফিরে দেখি লালমোহনবাবু সিটি ছেড়ে উঠে প্লেনের ল্যাজের দিকটায় চলেছেন। শেষটায় একজন এয়ার হাসটেস ওঁকে থামিয়ে উলটো দিকে দেখিয়ে দিতে ভদ্রলোক আবার সারা পথ হেঁটে সোজা পাইলটের দরজা খুলে ককপিটে ঢুকে তক্ষুনি বেরিয়ে এসে জিভা কেটে বাঁ দিকের দরজা দিয়ে বাথরুমে ঢুকলেন। নিজের সিটে ফেরার পথে আমার উপর ঝুকে পড়ে কানে ফিস্ ফিস করে বলে গেলেন, আমার পাশের লোকটিকে এক ঝলক দেখে নাও। হাই-জ্যাকার হলে আশ্চর্য হব না।
মাথা ঘুরিয়ে দেখে বুঝলাম জটায়ু অ্যাডভেঞ্চারের জন্যে একেবারে হন্যে হয়ে না থাকলে ও রকম নিরীহ, নেই-থুতনি মানুষটাকে কক্ষনও হাই-জাকার ভাবতেন না।
সান্টা ক্রুজে প্লেন ল্যান্ড করার ঠিক আগেই লালমোহনবাবু ব্যাগ থেকে বইটা বার করে রেখেছিলেন। ডোমেসটিক লাউঞ্জে ঢুকে আমরা তিনজনেই এদিক ওদিক দেখছি, এমন সময় মিস্টার গাঙ্গুলী? শুনে ডাইনে ঘুরে দেখি গাঢ় লাল রঙের টেরিলিনের শার্ট পরা একজন লোক মাদ্রাজি টাইপের এক ভদ্রলোককে প্রশ্নটা করে তার দিকে অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে চেয়ে আছে। ভদ্রলোক একটু যেন বিরক্ত ভাবেই মাথা নেড়ে না বলে লোকটাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন, আর লালমোহনবাবুও বই হাতে লাল শার্টের দিকে এগিয়ে গেলেন।
আই অ্যাম মিস্টার গাঙ্গুলী অ্যান্ড দিস ইজ ফ্রম মিস্টার সান্যাল, এক নিশ্বাসে বলে ফেললেন জটায়ু।
লাল শার্ট বইটা নিয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে গেলেন, আর লালমোহনবাবুও কর্তব্য সেরে নিশ্চিন্তে হাত ঝাড়লেন।
আমাদের মাল বেরোতে লাগল আধা ঘণ্টা। এখন একটা বেজে কুড়ি, শহরে পৌঁছতে পৌঁছতে হয়ে যাবে প্রায় দুটো। পুলক ঘোষাল গাড়ির নম্বরটা জানিয়ে দিয়েছিলেন আগেই, দেখলাম সেটা একটা গেরুয়া রঙের স্ট্যান্ডার্ড! ড্রাইভারটি বেশ শৌখিন ও ফিটফট; হিন্দি ছাড়া ইংরেজিটাও মোটামুটি জানে। কলকাতার তিনজন অচেনা লোকের জন্য ভাড়া খাটতে হচ্ছে বলে কোনওরকম বিরক্তির ভাব দেখলাম না। বরং লালমোহনবাবুকে যে রকম একটা সেলাম ঠুকল, তাতে মনে হল কাজটা পেয়ে সে কৃতাৰ্থ। ড্রাইভারই খবর দিল যে শহরের ভিতরেই শালিমার হোটেলে আমাদের থাকার বন্দোবস্ত হয়েছে, আর পুলকিবাবু বিকেল সাড়ে পাঁচষ্টার সময় হোটেলে এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করবেন। গাড়ি আমাদের জন্য রাখা থাকবে, আমরা যখন খুশি যেখানে ইচ্ছা যেতে পারি।