লালমোহনবাবুঝড়ের মতো লিখতে লিখতে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝিয়ে দিলেন।
আর সব শেষে–এটা একেবারে মাস্ট-চাই হ্যাপি এন্ডিং। তার আগে অবিশ্যি বার কয়েক কান্নার স্রোত বইয়ে দিতে পারলে শেষটা জমে ভাল।
লালমোহনবাবুর সে দিনই হাত ব্যথা হয়ে গিয়েছিল। তারপর গল্প নিয়ে ঝাড়া দু মাসেরধস্তাধস্তিতে ডান হাতের দুটো আঙুলে কড়া পড়ে গিয়েছিল। ভাগ্যিস সে সময়টা ফেলুদার কলকাতার বাইরে কোনও কাজ ছিল না-কেদার সরকারের রহস্যজনক খুনের তদন্তের ব্যাপারে ওকে সবচেয়ে বেশি দূর যেতে হয়েছিল ব্যারাকপুর—কারণ লালমোহনবাবু সপ্তাহে দু বার করে ফেলুদার কাছে এসে ধন দিচ্ছিলেন। তা সত্ত্বেও জটায়ুর বত্ৰিশ নম্বর উপন্যাস বোম্বাইয়ের বোম্বেটে মহালয়ার ঠিক পরেই বেরিয়ে যায়। আর গল্পটা যে রকম দাঁড়িয়েছিল, তা থেকে ছবি করলে আর যাই হোক, সে ছবি দেখে কোডোপাইরিন খেতে হবে না। হিন্দি ছবির মালমশলা থাকলেও তাতে হিন্দি ছবির ছেড়ে-দে-মা-কেঁদে-বাঁচি বাড়াবাড়িটা নেই।
পাণ্ডুলিপির একটা কপি পুলক ঘোষালকে আগেই পাঠিয়েছিলেন লালমোহনবাবু। দিন দশেক আগে চিঠি আসে যে, গল্প পছন্দ হয়েছে আর খুব শিগগিরই কাজ আরম্ভ করে দিতে চান পুলকবাবু। চিত্ৰনাট্য তিনি নিজেই করেছেন, আর হিন্দি সংলাপ লিখেছেন ত্রিভুবন গুপ্তে, যার এক-একটা কথা নাকি এক-একটা ধারালো চাকু, সোজা গিয়ে দর্শকের বুকে বিঁধে হলে পায়রা উড়িয়ে দেয়। এই চিঠির উত্তরে লালমোহনবাবু ফেলুদাকে কিছু না বলেই তাঁর গল্পের দাম হিসেবে পঁচিশ হাজার হাঁকেন, আর তার উত্তরেই আজকের টেলিগ্ৰাম। আমার মনে হল পঁচিশ চেয়ে লালমোহনবাবু যে একটু বাড়াবাড়ি করেছিলেন সেটা উনি নিজেই বুঝতে পেরেছেন।
গরম চায়ে চুমুক দিয়ে আধবোজা চোখে একটা আঃ শব্দ করে লালমোহনবাবু বললেন, পুলক ছোকরা লিখেছিল যে, গল্পটা বিশেষ চেঞ্জ করেনি; মোটামুটি আমি-থুড়ি, আমরা, যা লিখেছিলাম—
ফেলুদা হাত তুলে লালমোহনবাবুকে থামিয়ে বলল, আপনি বহুবচনটা না ব্যবহার করলেই খুশি হব।
কিন্তু-
আহাঃ–শেকসপিয়রও তো অন্যের গল্পের সাহায্য নিয়ে নাটক লিখেছে, তা বলে তাকে কি কেউ কখনও আমাদের হ্যাঁমলেট বলতে শুনেছে? কখখনও না। উপাদানে আমার কিছুটা কন্ট্রিবিউশন থাকলেও, পাচক তো আপনি। আপনার মতো হাতের তার কি আর আমার আছে?
লালমোহনবাবু কৃতজ্ঞতায় কান অবধি হেসে বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। —যাই হাক, যা বলছিলাম। কেবল একটি মাত্র মাইনর চেঞ্জ করেছে গল্পে।
কী রকম?
সে আর বলবেন না মশাই। তাজ্জব ব্যাপার। আপনি শুনলেই বলবেন টেলিপ্যাথি। হয়েছে কী, আমার গপ্লের স্মাগলার ঢুনূটিরাম ধুরন্ধরের বাসস্থান হিসেবে একটা তেতাল্লিশ তলা বাড়ির একটা ফ্ল্যাটের উল্লেখ করেছিলুম। আপনি খুঁটিনাটির ওপর নজর দিতে বলেন, তাই বাড়িটার একটা নামও দিয়েছিলুম-শিবাজী কাসল। বাম্বাই তো—তাই মহারাষ্ট্রের জাতীয় বীরপুরুষের নামে বাড়ির নামটা বেশ অ্যাপ্রোপ্রিয়েট মনে হয়েছিল। ওমা, পুলক লিখলে ওই নামে নাকি সত্যিই একটা উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ি আছে, আর তাতে নাকি ওর ছবির প্রোডিউসার নিজেই থাকেন। বলুন, একে টেলিপ্যাথি ছাড়া আর কী বলবেন?
কুং-ফু থাকছে, না বাদ? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
আমরা তিনজনে একসঙ্গে এনটার দ্য ড্রাগন দেখার পর থেকেই লালমোহনবাবুর মাথায় ঢুকেছিল যে গল্পে কুং-ফু ঢোকাবেন! ফেলুদার প্রশ্নের উত্তরে লালমোহনবাবু বললেন, আলবত থাকছে। সেটার কথা আমি আলাদা করে জিজ্ঞেস করেছিলুম; তাতে লিখেছে, ম্যাড্রার্স থেকে স্পেশালি কুং-ফু-র জন্য ফাইট মাস্টার আসছে। বলে নাকি হংকং-ট্রেনড।
শুটিং শুরু কবে?
সেইটে জিজ্ঞেস করে আজ একটা চিঠি লিখছি। জানার পর আমাদের যাবার তারিখটা ফিক্স করব। আমাদের-গুড়ি, আমার গল্পের শুটিং শুরু হবে, আর আমরা সেখানে থাকব না। সে কী করে হয় মশাই?
ডায়মন্ড এর আগেও খেয়েছি, কিন্তু আজকে যতটা ভাল লাগল। তেমন আর কোনওদিন লাগেনি।
০২. পরের রবিবার আবার লালমোহনবাবু
পরের রবিবার আবার লালমোহনবাবুর অবির্ভাব। ফেলুদা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল ভদ্রলোককে অর্ধেক খরচ অফার করবে, কারণ ওর নিজের হাতেও সম্প্রতি কিছু টাকা এসেছে। শুধু কেস থেকে নয়; গত তিন মাসে ও দুটো ইংরেজি বই অনুবাদ করেছে—উনবিংশ শতাব্দীর দুজন বিখ্যাত পর্যটকের ভ্ৰমণ কাহিনী-দুটোই ছাপা হচ্ছে, আর দুটো থেকেই কিছু আগাম টাকা পেয়েছে। ও। এর আগেও অবসর সময় ফেলুদাকে মাঝে মাঝে লিখতে দেখেছি।-কিন্তু আদা-নুন খেয়ে লিখতে লাগা এই প্রথম।
লালমোহনবাবু অবশ্যি ফেলুদার প্রস্তাব এক কথায় উড়িয়ে দিলেন। বললেন, খেপেছেন? লেখার ব্যাপারে আপনি এখন আমার গাইড়। অ্যান্ড গডফাদার। এটা হল আপনাকে আমার সামান্য দক্ষিণা।
এই বলে পকেট থেকে দুটো প্লেনের টিকিট বার করে টেবিলের উপর রেখে বললেন, মঙ্গলবার সকাল দশটা পায়তাল্লিশে ফ্লাইট। এক ঘণ্টা আগে রিপোটিং টাইম। আমি সোজা দমদমে গিয়ে আপনাদের জন্য ওয়েট করব।
শুটিং আরম্ভ হচ্ছে কবে?
বিষ্যুদ্বার। একেবারে ক্লাইম্যাকসের সিন। সেই ট্রেন, মোটর আর ঘোড়ার ব্যাপারটা।
এ ছাড়াও আর একটা খবর দেবার ছিল। লালমোহনবাবুর।
কাল সন্ধেবেলা আরেক ব্যাপার মশাই। এখানকার এক ফিলিম প্রোডিউসার–ধরমতলায় আপিস-আমার পাবলিশারের কাছ থেকে ঠিকানা জোগাড় করে সোজা আমার বাড়িতে গিয়ে হাজির! সেও বোম্বাইয়ের বোম্বেটে ছবি করতে চায়। বলে বাংলায় হিন্দি টাইপের ছবি না করলে আর চলছে না। গল্প বিক্রি হয়ে গেছে শুনে বেশ হতাশ হল। বইটা অবিশ্যি উনি নিজে পড়েননি; ওঁর এক ভাগনে পড়ে ওঁকে বলেছে। আমি বোম্বাই না গিয়েই বইটা লিখেছি শুনে বেশ অবাক হলেন। আমি আর ভাঙলুম না যে মারে-র গাইড ঢুঁ ইন্ডিয়া আর ফেলুমিত্তিরের গাইডেন্স ছাড়া এ কাজ হত না।