রিভলভারের পাশে হাতড়াতেই চাবি ঠেকাল হাতে।
দিয়ে দে।
আমি চাবি দিয়ে দিলাম মিঃ সান্যালকে। ফেলুদার হাত দুটো এখনও মাথার উপর। সান্যাল বাক্সের তালায় চাবি লাগিয়ে ঘোরালেন। বাক্স খুলে গেল। লাইফ ডিভাইন উপরেই রাখা। বাক্স থেকে বই বেরিয়ে এল।
জানালার ঠিক বাইরেই ঘোড়ার খুর। একটা নয়—অনেকগুলো—তীরবেগে নেমে আসছে পাহাড়ের গা বেয়ে, ছুটে চলেছে ট্রেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে।
সান্যাল বইটা হাতে, নিয়ে কয়েকটা পাতা উলটিয়ে যেখানে পৌঁছলেন, তার পরে আর উলটোনো যায় না। কারণ সেগুলো পরস্পরের সঙ্গে সাঁটা। এবার উলটোনোর বদলে সান্যাল একটা অদ্ভুত কাজ করলেন। পাতার মাঝখানটা খামচিয়ে সেটাকে ছিঁড়ে ফেললেন, আর ফেলতেই তার তলায় একটা চৌকো খোপ বেরিয়ে পড়ল। পাতাগুলোর মাঝখানটা একসঙ্গে কেটে ফেলে খোপটা তৈরি করা হয়েছে।
খোপের ভিতর দৃষ্টি দিতেই সান্যালের মুখের অবস্থা দেখবার মতো হল। উনি ভিতরে কী আশা করেছিলেন জানি না, এখন বেরোল খান আষ্টেক সিগারেটের পোড়া টুকরো, ডজন। খানেক পোড়া দেশলাই আর বেশ খানিকটা সিগারেটের ছাই।
কিছু মনে করবেন না, বলল ফেলুদা, ওটাকে ছাইদান হিসাবে ব্যবহার করার লোভ সামলাতে পারলাম না।
এবারে সান্যাল এত জোরে চ্যাচালেন যে, মনে হল সমস্ত ট্রেন ওর কথা শুনে ফেলবে।
বেয়াদবির আর জায়গা পাওনি? ভেতরের আসল জিনিস কোথায়?
কী জিনিসের কথা বলছেন আপনি?
স্কাউন্ড্রেল!-তুমি জানো না কীসের কথা বলছি?
নিশ্চয়ই জানি, তবু আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই!
কোথায় সে জিনিস?—আবার গৰ্জিয়ে উঠলেন মিঃ সান্যাল।
পকেটে।
কোন পকেটে?
বাঁ পকেটে।
ডাকাতের দল এখন জানালার ঠিক বাইরে, কারণ পাহাড় আরও কাছে চলে এসেছে। ধুলো এসে ঢুকছে আমাদের কামরায়।
ইউ দেয়ার!
আমি জানি আমার উপর আবার হুকুম হবে।
হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছ কী—যাও, হাত ঢোকাও।
আবার আদেশ মানতে হল।
এবার পকেট থেকে যে জিনিস বেরোল, তেমন জিনিস আমি কোনওদিন হাতে ধরিনি। হিরে আর মুক্তো দিয়ে গাঁথা এই আশ্চর্য হার রাজা-বাদশাদের হাতেই মানায়।
দাও ওটা আমাকে।
মিঃ সান্যালের চোখ জ্বলজ্বল করছে, কিন্তু এবার রাগে নয়, উল্লাসে, লোভে।
আমার হাত সান্যালের দিকে এগিয়ে গেল। ফেলুদার হাত মাথার উপর তোলা। লালমোহনবাবুর মুখ দিয়ে গোঙানির মতো শব্দ বেরোচ্ছে। ডাকাতের দল—
দড়াম্!
একটা ভারী শব্দের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কামরাটা যেন একটু কেঁপে উঠল, আর তার পরেই দেখলাম নিম্মো কামরার মেঝেতে গড়াগড়ি দিচ্ছে, কারণ একজোড়া পা জানালা দিয়ে ঢুকে সটান সজোরে লাথি মেরেছে তার গায়ে। ফলে নিম্মোর হাতের রিভলভার ছুটে দিয়ে সিলিং-এর বাতির কাচ চুরমার করে দিল, আর সেই সঙ্গে ফেলুদারও হাতে বিদ্যুদ্বেগে চলে এল তার নিজের রিভলভার।
এবারে পাহাড়ের দিকের দরজাটা আবার খুলে গেল, আর সেই দরজা দিয়ে ডাকাতের বেশে যিনি ঢুকলেন তাকে আমরা তিনজনেই খুব ভাল করে চিনি।
থ্যাঙ্ক ইউ, ভিক্টর, বলল ফেলুদা।
১১. তাঁর আর পালাবার পথ নেই
মিঃ সান্যাল সিটের উপর বসে পড়েছেন। এবার কাঁপুনিটা রাগের নয়, ভয়ের, কারণ তিনি জানেন তিনি জব্দ, তাঁর আর পালাবার পথ নেই।
এদিকে শুটিং-এ গণ্ডগোল বুঝে কেউ নিশ্চয়ই চেন টেনে দিয়েছে, কারণ ট্রেনটা যেভাবে থামাল সেটা চেন টানলেই হয়।
থামার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই শোরগোল শুনতে পেলাম। একই লোকের নাম ধরে অনেকে চিৎকার করছে।
ভিক্টর! ভিক্টর! কোথায় গেল, ভিক্টর?
পুলকবাবুর গলা। যত গণ্ডগোল তো ভিক্টরকে নিয়েই, কারণ তার লাফিয়ে পড়ার কথা ছাতে, আর সে কিনা সোজা এসে ঢুকেছে আমাদের কামরায়।
ফেলুদা দরজা খুলে মুখ বার করে পুলকবাবুকে ডাকলেন।
এই যে মশাই, এদিকে।
ভদ্রলোক হস্তদন্ত হয়ে আমাদের কামরায় উঠে এলেন। দেখে মনে হল তাঁর শেষ অবস্থা, কারণ শুনেছি। এই ধরনের একটা শটে গণ্ডগোল হওয়া মানে প্রায় ত্ৰিশ হাজার টাকা জলে যাওয়া।
ব্যাপার কী, ভিক্টর? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি?
আপনার ছবিতে জেট বাহাদুর আখ্যা একমাত্র ভিক্টর পেরুমলই পেতে পারে, পুলকবাবু।
তার মানে? পুলকবাবু অবাক হয়ে দেখলেন ফেলুদার দিকে। তার ফ্যালফালে ভাবটার মধ্যে এখনও যথেষ্ট পরিমাণে বিরক্তি মেশানো রয়েছে।
আর স্মাগলারের পার্টটা পরমেশ কাপুরকে না দিয়ে আপনার এঁকে দেওয়া উচিত ছিল।
কী সব উলটোপালটা বকছেন। ইনি কে? পুলকবাবু মিঃ সান্যালের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
ইতিমধ্যে ডানদিকের রাস্তায় দুটো নতুন গাড়ির আবির্ভাব হয়েছে—একটা পুলিশ জিপ আর একটা পুলিশ ভ্যান। জিপটা আমাদের কামরার পাশেই এসে থামল। তার থেকে নামলেন ইনস্পেক্টর পটবর্ধন।
এইবার পুলকবাবুর প্রশ্নের উত্তরে ফেলুদা মিঃ স্যানালের দিকে এগিয়ে গিয়ে দুই টানে তাঁর দাড়ি আর গোঁফ, আর আরও দুই টানে তাঁর পরচুলা আর চশমাটা খুলে ফেলে দিয়ে বলল—
আপনার গা থেকে গুলবাহারের গন্ধটাও টেনে খুলে ফেলতে পারলে খুশি হতাম মিস্টার গোরে, কিন্তু ওই একটি ব্যাপারে ফেলুমিত্তিরও অপারগ।
প্রোডিউসার মিসায় ধরা পড়লে ছবি বন্ধ হয়ে যাবে। এ কথা আপনাকে কে বললে, লালুদা?
প্রশ্নটা করলেন পুলকবাবু। লালমোহনবাবু কিছুই বলেননি, কেবল ঘাড় গোঁজ করে গভীর হয়ে বসে ছিলেন; যদিও এটা ঠিক যে গভীর হবার একটা কারণ হল জেট বাহাদুরের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে চিন্তা।