আমি অনেক দিন চেষ্টা করেছি। রাত্রে বিছানায় শুয়ে চোখ বুজে খেয়াল রাখতে ঠিক কোন সময় ঘুমটা আসে, কিন্তু প্রতিবারই পরদিন সকালে উঠে বুঝেছি, ঘুমটা কখন জানি আমার অজান্তেই এসে গেছে। আজও কখন ঘুমিয়েছি সেটা টের পাইনি। ঘুমটা ভাঙলি দরজায় ঘন ঘন ধাক্কা, আর সেই সঙ্গে বোতাম টেপার চৰ্দা শব্দে। উঠে দেখি, ফেলুদার ল্যাম্প তখনও জ্বলছে আর বালিশের পাশে রাখা আমার ঘড়িতে বলছে পৌনে একটা। ফেলুদা দরজা খুলতেই হুমড়ি দিয়ে প্রবেশ করলেন জটায়ু।
লালমোহনবাবু হাঁপালেও তিনি যে খুব ভয় পেয়েছেন সেটা কিন্তু মনে হল না, আর যে-কথাটা বললেন ঘরে ঢুকেই, সেটাও ভয়ের কথা নয়।
কেলেঙ্কারিয়াস ব্যাপার মশাই।
আগে খাটে এসে বসুন, বলল ফেলুদা।
দুর মশাই, বসব কী—এই দেখুন-কাঠমাণ্ডুর কী মহামূল্য ধনরত্ন আমার হাত দিয়ে পাচার করা হচ্ছিল।
লালমোহনবাবু ফেলুদার সামনে যেটা এগিয়ে ধরলেন, সেটা একটা বই। ইংরেজি বই, আর নাম-করা বই; ল্যান্সডাউনের মোড়ের দোকানো একটা রাখা ছিল, সে দিনও দেখেছি।
বইটা হল শ্ৰীঅরবিন্দের লেখা দ্য লাইফ ডিভাইন।
ফেলুদারও চোখ কপালে উঠে গেছে।
তার উপর আবার বাঁধাইয়ের গণ্ডগোল, বললেন লালমোহনবাবু! প্রথম ত্ৰিশ পাতার পর কয়েকটা পাতা পরস্পরের সঙ্গে সেঁটে আছে। এ বই না দেখে কিনলে তো পুরো টাকাটা ডেড লস মশাই। পণ্ডিচেরীর বাইন্ডার এ রকম কাঁচা কাজ করবে ভাবতে পারেন?
তা হলে সে দিন কী দিলেন লালশার্টের হাতে? জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।
জানেন কী দিলুম, ভাবতে পারেন? আমার নিজের বই মশাই, নিজের বই! বোম্বাইয়ের বোম্বেটে! পুলককে তো পাণ্ডুলিপির কপি পাঠিয়েছিলুম, তাই এবার ভাবলুম এক কপি ছাপা বই দেব-উইথ মই ব্রেসিংস অ্যান্ড মাই অটোগ্রাফ। আরও তিন কপি রয়েছে এখনও আমার ব্যাগে, প্রত্যেকটি ব্রাউন কাগজে মোড়া; আমার ভক্ত তো সারা ইন্ডিয়াতে ছড়িয়ে রয়েছে—তাই ভাবলুম, বম্বে যাচ্ছি, যদি এক-আধজনের সঙ্গে আলাপ-টালাপ হয়ে যায়, তাই সঙ্গে এনেছিলুম, আর তারই একটা কপি-হেঃ হেঃ হেঃ হাঃ!
এত হালকা লালমোহনবাবুকে অনেক দিন দেখিনি।
বইটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে ফেলুদা বলল, কিন্তু সান্যাল যে টেলিফোনে হুমকি দিল, সেটা কী ব্যাপার? এর সঙ্গে লাইফ ডিভাইন খাপ খাচ্ছে কি?
লালমোহনবাবু এতেও দমলেন না।
কে বলল সানাল? টেলিফোনে অত গলা চেনা যায় নাকি? কোনও উটকে বদমাশ রসিকতা করছে। হয়তো; বোম্বাইতে যদি তীরন্দাজ ছবি হিট হতে পারে তো সবই হতে পারে।
আর গাড়িতে গুলবাহার সেন্ট?
ওটা ওই ড্রাইভারই মাখে। কী রকম টেরির বাহার দেখেছেন? শৌখিন লোক। ধরা পড়ে অপ্রস্তুত হয়ে স্বীকার করলে না।
তা হলে আর কী, নিশ্চিন্তে ঘুমোন গিয়ে।
সে আর বলতে। মাথাটা ধরেছিল বলে ব্যাগটা খুলেছিলুম কোডোপাইরিনের জন্য, আর তাতেই এই হাই-ভোলটেজ আবিষ্কার। যাক, রহস্য যখন মিটেই গেল, তখন আপনিও বরং একটু আধ্যাত্মিক বিষয় অধ্যয়নে মনোনিবেশ করুন। বইটা রেখে গেলুম! গুড নাইট।
লালমোহনবাবু চলে গেলেন, আর আমিও আবার নিজের জায়গায় এসে শুলাম।
যে লোক আরবিন্দের বইয়ের বদলে জটায়ুর বই পেল, তার মনের অবস্থা কী হবে ফেলুদা।
খেপচুরিয়াস, বালিশে মাথা দিয়ে বলল ফেলুদা। মাথার পিছনের বাতিটা ও জ্বলিয়েই রাখল। দেখে হাসি পেল, ফেলুদা তার সবুজ নোটবই সরিয়ে রেখে অরবিন্দের লাইফ ডিভাইনের পাতা ওলটাল।
আমার বিশ্বাস ঠিক ওই সময়টাতেই আমার চোখ ঘুমে বন্ধ হল।
০৯. বম্বে থেকে পুণা
বম্বে থেকে পুণা যাবার পথে খাণ্ডালা আর লোনাউলির মাঝামাঝি একটা লেভেল ক্রসিং-এর কাছে আমাদের যেতে হবে শুটিং দেখতে। ছবির এগারোটা ক্লাইম্যাক্সের শেষ ক্লাইম্যাক্স দৃশ্য তোলা হবে। আজ; এক দিনে কাজ শেষ হবে না, পর পর আরও চার দিন যেতে হবে সবাইকে। আমরা ঠিক করেছি আজ যদি ভাল লাগে, তা হলে বাকি ক দিনও যাব। ট্রেনাটা এই পাঁচ দিনই পাওয়া যাবে, প্রতি দিনই ঠিক একটা থেকে দুটো-অৰ্থাৎ এক ঘণ্টার জন্য। ডাকাত দলের ঘোড়া আর হিরোর লিংকন কনভারটিবল থাকবে সারা দিনের জন্য। ভিলেন। ইঞ্জিন ড্রাইভারের জায়গা দখল করে ট্রেন চালিয়ে নিয়ে চলেছে, সেই ট্রেনেরই একটা কামরায় হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে রয়েছে হিরোইন আর তার কাকা। মোটরে করে হিরো ট্রেনের উদ্দেশে ধাওয়া করছে। এদিকে হিরোর যে যমজ ভাই—যাকে ছেলেবেলায় ডাকাতে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, আর যে, এখন নিজেই ডাকাত-সে। আসছে ঘোড়া করে দলবল নিয়ে ট্রেনটাকে অ্যাটাক করবে বলে! মোটরে হিরো এসে পৌঁছনোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ড্রাকাত ভাই ঘোড়া থেকে চলন্ত ট্রেনে লাফিয়ে পড়ে ৪ ইঞ্জিনের ভিতর ফাইট হয়, ভিলেন-ড্রাইভার খতম হয়। সেই সময় মোটরে করে হিরো এসে পড়ে, আর তারপর.বাকি অংশ রুপালি পদায় দেখিবেন। আসলে শেষটা নাকি তিন রকম ভাবে তোলা হবে, তারপর পর্দায় যেটা বেশি ভাল লাগে সেটা রাখা হবে।
পুলকবাবু সকালে তিন মিনিটের জন্য ঢুঁ মেরে গেছেন। আমাদের ব্যবস্থা সব ঠিকঠাক জেনে বললেন, লালুদা, আপনাকে দেখেই বুঝতে পারছি তীরন্দাজ। আপনার খুব ভাল লেগেছে।
আসলে লালমোহনবাবু সকাল থেকেই রাত্তিরের ঘটনাটা ভেবে ক্ষণে ক্ষণে আপন মনে হেসে ফেলছিলেন; পুলকবাবুর সামনে সেই হাসিটাই বেরিয়ে পড়েছিল। এখন পুলকবাবুর কথা শুনে আরও জোরে হেসে বললেন, ওঃ-গড়পারের ছেলে—তুমি দ্যাখালে ভাই।–হাঃ।