হোটেলে ফিরে এসে কথাটা ফেলুদাকে বলতে ও বলল, রহস্য যখন জাল বিস্তার করে, তখন এইভাবেই করে, লালমোহনবাবু। এ না হলে জাত-রহস্য হয় না, আর তা না হলে ফেলুমিত্তিরের মস্তিষ্কপুষ্টি হয় না।
কিন্তু-
আমি জানি আপনি কী প্রশ্ন করবেন, লালমোহনবাবু। না, কিনারা এখনও হয়নি। এখন শুধু জালের ক্যারেকটারটা বোঝার চেষ্টা করছি।
তুমি বেরিয়েছিলে বলে মনে হচ্ছে?—আমি ধাঁ করে একটা গোয়েন্দা-মার্কা প্রশ্ন করে বসলাম।
সাবাস তোপ্সে। তবে হোটেল থেকে বেরোইনি। এটা নীচে রিসেপশনেই দিল।
ফেলুদার পাশে একটা ইন্ডিয়ান এয়ার লাইনসের টাইমটেবিল ছিল, সেটা দেখেই আমি প্রশ্নটি করেছিলাম।
দেখছিলাম কাঠমাণ্ডু থেকে কটা ফ্লাইট কলকাতায় আসে, আর কখন আসে।
কাঠমাণ্ডু বলতেই একটা জিনিস ফেলুদাকে জিজ্ঞেস করার কথা মনে পড়ে গেল।
আচ্ছা, ইনস্পেক্টর পটবর্ধন যে নানাসাহেবের কথা বলেছিলেন, সেটা কোন নানাসাহেব?
ভারতবর্ষের ইতিহাসে একজন নানাসাহেবই বিখ্যাত।
যিনি সিপাহি বিদ্রোহে ব্রিটিশদের সঙ্গে লড়েছিলেন?
লড়েওছিলেন, আবার তাদের কাছ থেকে আত্মরক্ষার জন্য দেশ ছেড়ে পালিয়েও ছিলেন। হাজির হয়েছিলেন গিয়ে একেবারে কাঠমাণ্ডু। সঙ্গে ছিল মহামূল্য ধনরত্ন-ইনকুডিং হিরে আর মুক্তোয় গাঁথা একটি হার—যার নাম নওলাখী! সেই হার শেষ পর্যন্ত চলে যায় নেপালের জং বাহাদুরের কাছে। তার পরিবর্তে জং বাহাদুর দুটি গ্রাম দিয়েছিলেন নানাসাহেবের স্ত্রী কাশীবাঈকে।
এই হার কি নেপাল থেকে চুরি হয়ে গেছে নাকি?
পটবর্ধনের কথা শুনে তো তাই মনে হয়।
আমি কি ওই হারই পাচার করে বসলুম নাকি মশাই? লালমোহনবাবু তারস্বরে চেঁচিয়ে প্রশ্নটা করলেন। ফেলুদা বলল, ভেবে দেখুন। ইতিহাসে হিরের অক্ষরে লেখা থাকবে আপনার নাম।
কিন্তু…কিন্তু… সে তো তা হলে যথাস্থানে পৌঁছে গেছে। সে জিনিস দেশ থেকে বাইরে যায় কি না যায় সে তো দেখবে পুলিশ। আপনি কী নিয়ে এত ভাবছেন? আপনি নিজেই কি এই স্মাগলারদের–
ঠিক এই সময়ই টেলিফেনটা বেজে উঠল। আর লালমোহনবাবুর দিকেই ওটা ছিল বলে উনি তুলে নিলেন।হ্যালো-হ্যাঁ, মানে ইয়েস-স্পিকিং।
লালমোহনবাবুরই ফোন। বাধ হয় পুলকবাবু। না, পুলকবাবু না। পুলকবাবু এমন কিছু বলতে পারেন না যাতে লালমোহনবাবুর মুখ অতটা হা হয়ে যাবে, আর টেলিফোনটা কাঁপতে কাঁপতে কান থেকে পিছিয়ে আসবে।
ফেলুদা ভদ্রলোকের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে একবার কানে দিয়ে বোধহয় কিছু না শুনতে পেয়েই সেটাকে যথাস্থানে রেখে দিয়ে প্রশ্ন করল, সান্যাল কি?
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতেও যেন কষ্ট হল ভদ্রলোকের। বুঝলাম মাস্লগুলো ঠিকভাবে কাজ করছে না।
কী বলল? আবার ফেলুদা।
বলল– লালমোহনবাবু গা-ঝাড়া দিয়ে মনে সাহস আনার চেষ্টা করলেন।বলল—মু-মুখ খুললে পেপ-পেট ফাঁক করে দেবে।
যাক–ভাল কথা।
অ্যাঁ!–বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে ফেলুদার দিকে চাইলেন লালমোহনবাবু। আমার কাছেও এই অবস্থায় ফেলুদার হাঁপা ছাড়াটা বেয়াড়ী বলে মনে হচ্ছিল। ফেলুদা বলল, শুধু গুলবাহারের গন্ধে হচ্ছিল না। কু হিসেবে ওটা বড্ড পলকা। এমনকী লোকটা সত্যি করে বম্বে এসেছে না। অন্য কেউ সেন্টটা ব্যবহার করছে, সেটাও বোঝা যাচ্ছিল না। এখন অন্তত শিওর হওয়া গেল।
কিন্তু আমার পেছনে লগা কেন?
মরিয়া হয়ে প্রশ্নটা করলেন লালমোহনবাবু। সেটা জানলে তো বাজিমাত হয়ে যেত লালমোহনবাবু। সেটা জানার জন্য একটু ধৈর্য ধরতে হবে।
০৮. লালমোহনবাবু ডিনারে
লালমোহনবাবু ডিনারে বিশেষ সুবিধে করতে পারলেন না, কারণ ওঁর নাকি একদম খিদে নেই। ফেলুদা বলল তাতে কিছু এসে যাবে না, কারণ দুপুরে কপার চিমনিতৃ পেট পুজোঁটা ভালই হয়েছে। সত্যি বলতে কী, আমাদের মধ্যে লালমোহনবাবুই সবচেয়ে বেশি খেয়েছিলেন।
খাওয়ার পর গতকাল তিনজনেই বেরিয়ে গিয়ে পান। কিনেছিলাম। আজ লালমোহনবাবু কিছুতেই বেরোতে চাইলেন না। বললেন, ওই ভিড়ের মধ্যে কে যাচ্ছে মশাই? সান্যালের লোক নিৰ্ঘাত হোটেল ওয়াচ করচে, বেরোলেই চাক্কু।
শেষ পর্যন্ত ফেলুদাই বেরোল, লালমোহনবাবু আমাদের ঘরে আমার সঙ্গে বসে রইলেন, আর বার বার খালি বলতে লাগলেন, কী কুক্ষণেই বইয়ের প্যাকেটটা নিয়েছিলাম। ক্ৰমে বর্তমান সংকটের মূল কারণ খুঁজতে খুঁজতে কী কুক্ষণেই হিন্দি ছবির জন্য গল্প লিখেছিলাম, আর সব শেষে কী কুক্ষণেই রহস্য উপন্যাস লিখতে শুরু করেছিলাম পর্যন্ত চলে গেলেন।
আপনার একা শুতে ভয় করবে না তো? ফেলুদা পান বিলি করে জিজ্ঞেস করল। লালমোহনবাবু কোনও উচ্চবাচ্য করছেন না দেখে ফেলুদা আশ্বাস দিয়ে বলল, আমাদের ঘর। থেকে বেরিয়েই প্যাসেজের ধরে একটা ছোট্ট ঘর আছে দেখেছেন তো? ওখানে সব সময় বেয়ারা থাকে। হোটেলে সারা রাত কেউ না কেউ জেগে থাকে। এ তো আর শিবাজী কাসল না।
শিবাজী কাসল নামটা শুনে লালমোহনবাবু আরেকবার শিউরে উঠলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনে সাহস এনে দশটা নাগাদ গুইেডনাইট করে নিজের ঘরে চলে গেলেন।
সারা দিন বম্বে চষে বেড়ানোর চেয়েও পুলকবাবুর ছবির অর্ধেক দেখে অনেক বেশি। কহিল লাগছিল, তাই জটায়ু চলে যাবার মিনিট দিশেকের মধ্যেই শুয়ে পড়লাম! ফেলুদা যে এখন শোবে না, সেটা জানি। ওর নোটবুকটা খাটের পাশেই টেবিলের উপর রাখা রয়েছে, সারা দিন খেপে খেপে তাতে অনেক কিছু লেখা হয়েছে, হয়তো আরও কিছু লেখা হবে।